প্রকাশিত: : এপ্রিল ২৪, ২০২৫, ০৬:০৩ পিএম
ভারতশাসিত কাশ্মীরের পহেলগামে মঙ্গলবারের ভয়াবহ হামলাকে ২০১৯ সালের পর থেকে সবচেয়ে মারাত্মক জঙ্গি হামলা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ছুটিতে আসা সাধারণ পর্যটকদের লক্ষ্য করে চালানো এই হামলায় প্রাণ গেছে অন্তত ২৬ জনের। নিহতদের মধ্যে কেউই সেনাসদস্য ছিলেন না, বরং তাঁরা ছিলেন বেসামরিক নাগরিক—যা পুরো ঘটনার নৃশংসতা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
এই হামলা শুধু মানুষের জীবনহানির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং কাশ্মীরের ভঙ্গুর শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফিরিয়ে আনার চেষ্টার ওপরও এটি ছিল একটি পরিকল্পিত আঘাত।
ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশই কাশ্মীরের ওপর পূর্ণ অধিকার দাবি করে থাকলেও, বাস্তবে অঞ্চলটির নিয়ন্ত্রণ রয়েছে উভয়ের অংশিক শাসনে। অতীতে এই অঞ্চলের ইতিহাস বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এবারও ভারতের প্রতিক্রিয়ায় সামরিক কড়া পদক্ষেপের সম্ভাবনা রয়েছে।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং ইতিমধ্যেই ‘কঠোর জবাব’ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি কেবল হামলাকারীদের নয়, বরং ভারতের ভূখণ্ডে এই হামলার পেছনে থাকা ‘মাস্টারমাইন্ডদের’ বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন।
দিল্লি ইতিমধ্যেই একাধিক পদক্ষেপ নিয়েছে—মুখ্য সীমান্ত ক্রসিং বন্ধ করা, গুরুত্বপূর্ণ জলচুক্তি স্থগিত করা এবং পাকিস্তানি কূটনীতিক বহিষ্কারের মতো সিদ্ধান্ত তার মধ্যে অন্যতম।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রশ্নটা এখন আর এই নয় যে ভারত প্রতিক্রিয়া জানাবে কি না; বরং কখন এবং কী মাত্রায় তা জানাবে, সেটাই মূল বিষয়। সামরিক ইতিহাসবিদ শ্রীনাথ রাঘবনের মতে, ২০১৬ ও ২০১৯ সালের মতোই এবারও সীমান্ত পেরিয়ে হামলা বা বিমান হামলার মতো কঠোর পদক্ষেপের আশঙ্কা রয়েছে।
২০১৬ সালে উরিতে ১৯ সেনা নিহত হওয়ার পর ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ এবং ২০১৯ সালে পুলওয়ামায় আধাসামরিক বাহিনীর ৪০ সদস্য নিহত হওয়ার পর বালাকোটে বিমান হামলা চালিয়েছিল ভারত। প্রতিবারই পাকিস্তান পাল্টা জবাব দিয়েছে, তবে উভয়পক্ষ পূর্ণমাত্রার যুদ্ধ এড়িয়েছে।
২০২১ সালে দুই দেশ ‘সিজফায়ার’ চুক্তিতে পৌঁছালেও কাশ্মীরে ছিটেফোটা হামলা চলছেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার বেসামরিকদের লক্ষ্য করে হামলার কারণে ভারতের প্রতিক্রিয়া আরও জোরালো হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান জানিয়েছেন, “ভারত যদি মনে করে পাকিস্তান এই হামলায় সরাসরি বা পরোক্ষভাবে জড়িত, তাহলে সামরিক জবাবের সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়।” তার মতে, এই ধরনের পদক্ষেপ ভারতের জন্য রাজনৈতিকভাবেও লাভজনক হতে পারে।
তবে প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে উচ্চ ঝুঁকি। সামরিক প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে এবং সংঘাতের আশঙ্কা তৈরি হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের গবেষক ক্রিস্টোফার ক্ল্যারি মনে করেন, ভারতের সামনে সীমান্তে আবার গুলি ছোড়া বা বিমান হামলার মতো পদক্ষেপ খোলা রয়েছে, তবে সবকটাই ঝুঁকিপূর্ণ।
দুই দেশই পরমাণু শক্তিধর হওয়ায় উত্তেজনার প্রতিটি ধাপই বৈশ্বিক উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিক্রিয়া সীমিত হলেও তার ফলাফল ভয়াবহ হতে পারে, যদি তা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে।
শ্রীনাথ রাঘবনের মতে, “যে কোনো পদক্ষেপ অবশ্যই সুনির্দিষ্ট এবং লক্ষ্যভিত্তিক হতে হবে। কারণ পাকিস্তানও জবাব দিতে পারে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।”
ইসরায়েল-ইরান সংকটের সঙ্গে তুলনা করে তিনি বলেন, “প্রথমে উত্তেজনা বাড়ে, তারপর তা প্রশমনের চেষ্টা হয়। কিন্তু সব সময় তা পরিকল্পনা অনুযায়ী চলে না।”
সাবেক কূটনীতিক হুসেন হক্কানিও মনে করেন, সীমিত পরিসরে ভারতের সামরিক জবাব দিলেও পাকিস্তান তা সহজভাবে নাও নিতে পারে এবং পাল্টা প্রতিক্রিয়া আসতে পারে।
সবশেষে, পহেলগামের ভয়াবহ হামলা ভারতের নিরাপত্তা ব্যবস্থার একটি বড় ত্রুটির দিকেই ইঙ্গিত করছে বলে মত দিয়েছেন রাঘবন। তার মতে, “যখন পর্যটন মৌসুম শীর্ষে, তখন এমন হামলা নিঃসন্দেহে নিরাপত্তা ব্যর্থতার চিহ্ন বহন করে। বিশেষ করে এমন একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে, যেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।”
কাশ্মীরের শান্তি আবার নতুন করে অস্থিরতার মুখে পড়েছে, এবং উত্তেজনার এই আবহে সামনের দিনগুলোতে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক কোন দিকে মোড় নেয়, সেটিই এখন দেখার বিষয়।