প্রকাশিত: : মার্চ ২৬, ২০২৫, ০৫:১৩ পিএম
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তারা একটি মেসেজিং অ্যাপে ইয়েমেনে হুথি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সামরিক হামলা চালানোর পরিকল্পনা করছিলেন। তবে সে গ্রুপ চ্যাটে ভুলক্রমে এক সাংবাদিককে যোগ করা হয়, আর এতেই ফাঁস হয়ে যায় সেই গোপন পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। হোয়াইট হাউজ এ ঘটনা নিশ্চিত করার পর দেশটির রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
`দ্য আটলান্টিক` পত্রিকার প্রধান সম্পাদক জেফরি গোল্ডবার্গ সোমবার এক প্রতিবেদনে জানান, ১৩ মার্চ তিনি হঠাৎ করেই সিগন্যাল নামের এনক্রিপ্টেড মেসেজিং অ্যাপে একটি চ্যাট গ্রুপে যুক্ত হন। ওই গ্রুপের নাম ছিল `হুথি পিসি স্মল গ্রুপ`। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়াল্টজ তার ডেপুটি অ্যালেক্স ওয়ংকে নির্দেশ দেন একটি `টাইগার টিম` গঠন করতে, যার কাজ হবে হুথিদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের সমন্বয় করা। গোল্ডবার্গ দাবি করেন, হামলার কয়েক ঘণ্টা আগে প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ ওই গ্রুপে অপারেশন সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য পোস্ট করেন। সেখানে সম্ভাব্য হামলার লক্ষ্যবস্তু, ব্যবহৃত অস্ত্র এবং হামলার ধাপে ধাপে পরিকল্পনার তথ্য উল্লেখ ছিল। তিনি এটিকে `অবিশ্বাস্যভাবে অবহেলামূলক` একটি ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করেন।
হোয়াইট হাউজের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের (এনএসসি) মুখপাত্র ব্রায়ান হিউজ জানিয়েছেন, চ্যাট গ্রুপটি `আসল` ছিল এবং বিষয়টি এখন খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তিনি বলেন, `এটি অনিচ্ছাকৃত ভুল ছিল, এবং আমরা পর্যালোচনা করছি কীভাবে একটি ভুল নম্বর চ্যাট গ্রুপে যুক্ত হলো।` তবে তিনি দাবি করেন, এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে জাতীয় নিরাপত্তার কোনো ধরনের হুমকি তৈরি হয়নি। হিউজ বলেন, `হুথিদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান সফল হয়েছে, এবং এতে কোনো সামরিক ঝুঁকি তৈরি হয়নি।`
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই ঘটনার বিষয়ে সাংবাদিকদের কাছে বলেন, `আমি এ বিষয়ে কিছু জানি না। আমি "দ্য আটলান্টিক"-এর খুব বড় ভক্ত নই।` পরে হোয়াইট হাউজের এক কর্মকর্তা জানান, এ বিষয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে এবং প্রেসিডেন্টকে ঘটনার ব্যাপারে অবহিত করা হয়েছে।
ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসার পর ডেমোক্রেট আইনপ্রণেতারা একে গুরুতর নিরাপত্তা লঙ্ঘন বলে আখ্যায়িত করেন এবং কংগ্রেসে তদন্তের দাবি তোলেন। সিনেটের ডেমোক্রেট নেতা চাক শুমার বলেন, `এটি যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক পরিকল্পনার একটি গুরুতর ফাঁস, যা আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি।` অন্যদিকে, রিপাবলিকান নেতারা বিষয়টি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। কেউ কেউ একে `সরকারি অব্যবস্থাপনার চূড়ান্ত উদাহরণ` বলেছেন, আবার কেউ একে বড় ধরনের ইস্যু বলে মনে করছেন না।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ অবশ্য এই অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করেছেন। হাওয়াইয়ে এক সরকারি সফরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, `কেউ কোনো যুদ্ধ পরিকল্পনা টেক্সট করেনি। আমার এ নিয়ে বলার কিছু নেই।` তবে গোল্ডবার্গ এই দাবিকে সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, `না, এটা মিথ্যা। তিনি (হেগসেথ) যুদ্ধ পরিকল্পনার তথ্যই পাঠিয়েছেন।`
গোল্ডবার্গের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ওই চ্যাট গ্রুপে ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও, সিআইএ পরিচালক জন র্যাটক্লিফ, জাতীয় গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান তুলসী গ্যাবার্ড, ট্রেজারি সেক্রেটারি স্কট বেসেন্ট, হোয়াইট হাউজ চিফ অব স্টাফ সুজি ওয়াইলস এবং জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের সিনিয়র কর্মকর্তারা অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এছাড়া, ন্যাশনাল কাউন্টারটেররিজম সেন্টারের মনোনীত পরিচালক জো কেন্টও এই চ্যাটে যুক্ত ছিলেন, যদিও তিনি তখনো সিনেটের অনুমোদন পাননি।
চ্যাটের আলোচনায় ইউরোপের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেওয়া নিয়েও মন্তব্য করা হয়। গোল্ডবার্গের প্রতিবেদনে বলা হয়, মাইক ওয়াল্টজের নামে থাকা এক অ্যাকাউন্ট থেকে লেখা হয়, `এখন বা কয়েক সপ্তাহ পর—যখনই হোক, শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকেই এই শিপিং রুটগুলো পুনরায় নিরাপদ করতে হবে।` ভাইস প্রেসিডেন্ট ভ্যান্স এ প্রসঙ্গে বলেন, `আমি ইউরোপকে আবারও উদ্ধার করতে চাই না।` তারপর প্রতিরক্ষামন্ত্রী হেগসেথ তাতে সাড়া দিয়ে বলেন, `ভিপি, ইউরোপের ওপর আমাদের নির্ভরতার প্রতি আপনার ক্ষোভ আমি পুরোপুরি ভাগাভাগি করি। এটা একদমই লজ্জাজনক।`
গোল্ডবার্গ তার প্রতিবেদনে আরও জানান, ১৪ মার্চ ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স ওই চ্যাটে হামলার সময় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, `আমি নিশ্চিত নই যে প্রেসিডেন্ট বুঝতে পারছেন এটি ইউরোপ সংক্রান্ত তার বর্তমান নীতির সঙ্গে কতটা সাংঘর্ষিক।` তিনি আরও বলেন, `এর ফলে তেলের মূল্য বাড়তে পারে এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে। তবে আমি দলে ঐক্য রাখতে চাই এবং আপাতত এ নিয়ে বেশি কথা বলছি না।`
এই তথ্য প্রকাশ্যে আসার পর ভ্যান্সের কার্যালয় থেকে একটি বিবৃতি দেওয়া হয়। তাতে বলা হয়, `ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স এই প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতিকে পুরোপুরি সমর্থন করেন। প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট এ বিষয়ে আলোচনার পর এখন সম্পূর্ণ ঐক্যমত্যে পৌঁছেছেন।`
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে মার্কিন প্রশাসনের সামরিক নীতির গোপনীয়তা এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামরিক পরিকল্পনা নিয়ে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত তথ্য ফাঁস ভবিষ্যতে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি তৈরি করতে পারে।