প্রকাশিত: : মার্চ ১৩, ২০২৫, ০১:১৫ পিএম
শিক্ষাবিরতিতে বাড়ছে শিখন ঘাটতি, সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র পরিবারের শিশুরা
গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার একটি বেসরকারি বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী নওশিন জাহান (ছদ্মনাম)। বছরের দুই মাস পার হয়ে গেলেও এখনো হাতে আসেনি সব বই। এর মধ্যেই দীর্ঘ ছুটিতে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে তাদের। রমজান, ঈদুল ফিতরের ছুটির পাশাপাশি নওশিনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র হওয়ায় ক্লাস শুরু হতে অপেক্ষায় থাকতে হবে মে মাস পর্যন্ত। সে হিসাবে তারা পড়েছে টানা ৭০ দিনের ছুটির ফাঁদে। দেরিতে বই পাওয়া এবং দীর্ঘ ছুটির কারণে নির্ধারিত সময়ে সিলেবাস শেষ করা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন অভিভাবকরা।
নওশিনের মা বলেন, ‘আমার স্বামী একজন কম্পিউটার অপারেটর। বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় নির্ধারিত সময়ে সিলেবাস শেষ করতে হলে গৃহশিক্ষকের দ্বারস্থ হতে হবে। কিন্তু তার জন্য যে পরিমাণ টাকার প্রয়োজন তা আমাদের মতো পরিবারের পক্ষে জোগানো সম্ভব না। তাই ছুটির কারণে আমার মেয়ে অনেকটা পিছিয়ে পড়বে, এটি মেনে নিতেই হবে।’
কেবল নওশিন নয়, একই পরিস্থিতি দেশের সাধারণ শিক্ষাক্রমের আওতাধীন প্রায় সব শিক্ষার্থীর। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, কারিকুলাম পরিবর্তন ও পাঠ্যপুস্তক সংশোধনের কারণে এ বছর তারা জানুয়ারিতে সব বই হাতে পায়নি। এমনকি দুই মাস পার হলেও মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের বড় অংশের কাছেই সব বই পৌঁছায়নি। ফলে তারা আবারো শিখন ঘাটতিতে পড়তে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনার প্রাদুর্ভাবে প্রায় দেড় বছর শিক্ষার্থীরা শিক্ষাকার্যক্রমের বাইরে থাকায় তাদের মধ্যে একটি বড় ধরনের শিখন ঘাটতি রয়ে গেছে। করোনা-পরবর্তী সময়ে এ ঘাটতি কাটাতে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়নি। উল্টো একের পর এক ছুটির কারণে শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি আরো বেড়ে গেছে। বিশেষত দরিদ্র পরিবারের শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এ কারণে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বিগত এক বছরের ছুটির তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০২৪ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৫ সালের মার্চ পর্যন্ত প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত মোট কর্মদিবস ছিল ২৬১ দিন। এর মধ্যে ছুটিতেই গেছে ১১০ দিন। সে হিসেবে প্রায় অর্ধেক কর্মদিবসই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাস-পরীক্ষা হয়নি। আর এমন পরিস্থিতিতে উচ্চ ও মধ্যবিত্তের সন্তানদের গৃহশিক্ষক কিংবা কোচিংয়ে ক্লাস করিয়ে কিছুটা শিখন ঘাটতি পূরণ করা হয়। সমস্যায় পড়ে মূলত দরিদ্র পরিবারের শিশুরা।
এদিকে সাধারণ শিক্ষাক্রমের আওতাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো ছুটি থাকলেও বিপরীত চিত্র দেশের ইংরেজিমাধ্যম বিদ্যালয় ও কিন্ডারগার্টেনগুলোয়। রাজধানীর মিরপুর ১০, শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া, ফার্মগেট ও মতিঝিল এলাকা গতকাল ঘুরে দেখা গেছে, সেখানকার প্রায় সব ইংরেজিমাধ্যম বিদ্যালয় ও বেশির ভাগ কিন্ডারগার্টেনেই চলছে পাঠদান।
বাংলাদেশ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল প্যারেন্টস ফোরামের সভাপতি একেএম আশরাফুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রমজানে স্কুল ছুটি দেয়া হলে প্রায় ৪০ দিনের একটি শিক্ষাবিরতি তৈরি হয়। এ ঘাটতি পরবর্তী সময়ে কাটিয়ে ওঠা কঠিন। এ কারণে ইংরেজিমাধ্যমের হাতে গোনা ৮-১০টি বিদ্যালয় ছাড়া প্রায় সবগুলোই ১৫-২০ রমজান পর্যন্ত পরীক্ষা-পাঠদান চালু রাখছে। তবে সময় কমিয়ে আনা হয়েছে। আমরা অভিভাবকরাও নির্ধারিত সময়ে সিলেবাস সম্পন্নের বিষয়টি বিবেচনা করে স্কুল খোলা রাখাকে সমর্থন করছি।’
শিক্ষা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থাগুলোর মোর্চা গণসাক্ষরতা অভিযান করোনা-পরবর্তী সময়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে উল্লেখ করা হয়, প্রাথমিকের ৯৮ দশমিক ২৬ শতাংশ শিক্ষক ও মাধ্যমিকের ৯৬ দশমিক ৭৩ শতাংশ শিক্ষক জানিয়েছেন, করোনার প্রাদুর্ভাবে বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি তৈরি হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে আরো উঠে এসেছে, সপ্তম ও নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের মধ্যে গ্রামাঞ্চলের প্রায় ৮৮ শতাংশ ও শহরাঞ্চলের ৯১ দশমিক ৪ শতাংশই কোচিং বা গৃহশিক্ষকের সহযোগিতা নেয়।
জানতে চাইলে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের সাধারণ শিক্ষাক্রমে একের পর এক বিরতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে বড় ধরনের শিখন ঘাটতি তৈরি করছে এবং সামাজিক বৈষম্য বাড়িয়ে দিচ্ছে। দেখা যাচ্ছে সমাজে যারা বিত্তবান তারা সন্তানদের ইংরেজিমাধ্যমে পড়াচ্ছেন, কিন্ডারগার্টেনে পড়াচ্ছেন, কোচিং, টিউশনের ব্যবস্থা করছেন। সাধারণ স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকলেও ইংরেজিমাধ্যম স্কুলগুলো, কিন্ডারগার্টেনগুলোয় পাঠদান চলছে, তারা সময়ের সঙ্গে এগিয়ে যেতে পারছে। কিন্তু পিছিয়ে থাকছে আমাদের নিম্নবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের শিশুরা, প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশুরা।’
এ শিক্ষাবিদ আরো বলেন, ‘জুলাই আন্দোলনে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো প্রায় এক মাস বন্ধ ছিল। আবার সামনে তাপপ্রবাহের কারণে বন্ধের সম্ভাবনা আছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের ৪০ দিনের ছুটি কমিয়ে আনার বিষয়টি বিবেচনা করা প্রয়োজন ছিল।’
একই কথা বলছেন অভিভাবকরাও। তারা বলছেন, প্রাথমিকের চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণী এবং মাধ্যমিকের অষ্টম ও নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের নামমাত্র দু-তিনটি করে বই দেয়া হয়েছে। ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরাও সব বই পায়নি। প্রাথমিকের প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীরাও পায়নি অনেকে বই। এর মধ্যে দীর্ঘ ছুটি দেয়ায় শিক্ষার্থীরা বড় শিখন ঘাটতির মুখে পড়তে যাচ্ছে। কেননা বছরের প্রথম দু-তিন মাস ভালো ক্লাস না হলে পরবর্তী সময়ে সংকট আরো বাড়বে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেও স্কুল বন্ধ রাখতে হয়। ফলে ছুটির মধ্যে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ঠিক রাখতে বিশেষ নির্দেশনা দেয়ার প্রয়োজন ছিল, যা সরকার করেনি।
অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মো. জিয়াউল কবির দুলু বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত অনেক স্কুল সব পাঠ্যবই পায়নি, ক্লাস করাতে পারেনি এবং বার্ষিক খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষ করতে পারেনি। শিক্ষার্থীরা শিখনকাজে পিছিয়ে আছে এবং বিভিন্ন কারণে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম ও শিখনে ঘাটতি রয়ে গেছে। এছাড়া নিয়ম অনুযায়ী বিভিন্ন স্কুল-কলেজে শ্রেণীতে শিক্ষা ঘণ্টা বাস্তবায়ন হয় না। ঢাকা শহরে দুই শিফটের স্কুলে ৪ ঘণ্টার বেশি ক্লাস করানো হয় না। এর মধ্যে সাপ্তাহিক ছুটি দুদিন। আগামী এপ্রিলে এসএসসি পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। যেসব স্কুলে পরীক্ষার কেন্দ্র রয়েছে সেগুলো বন্ধ থাকবে। এছাড়া ক্লাসে না পড়িয়ে কতিপয় শিক্ষক নামধারী ব্যবসায়ী কোচিং বাণিজ্যের জন্য শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে কোচিং করতে বাধ্য করেন। এগুলোর উত্তরণ দরকার। তাই সবকিছু বিবেচনায় আমরা চেয়েছিলাম কমপক্ষে ২০ রমজান পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু থাকুক।’
এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের (মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ) সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়েরের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
শিক্ষাপঞ্জি নতুনভাবে তৈরি করা উচিত বলে মনে করেন প্রাথমিক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মানোন্নয়নে গঠিত পরামর্শক কমিটির আহ্বায়ক ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. মনজুর আহমেদ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘বর্তমান শিক্ষাপঞ্জিতে যেভাবে ছুটি রয়েছে সেক্ষেত্রে সংশোধন দরকার। দেখা যায়, আবহাওয়া যখন সহনীয় থাকে তখন বিদ্যালয় বন্ধ থাকছে। আবার যখন তীব্র তাপপ্রবাহ থাকে তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকে। সর্বশেষ ৪০ দিনের যে ছুটি দেয়া হয়েছে সেটি আরো কমানো উচিত ছিল। আমার মনে হয় সরকার এ ছুটির সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের অবস্থান এবং তাদের মানোন্নয়নের বিষয়টি বিবেচনা না করে জনগণের প্রতিক্রিয়ারকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে।’
নানা ধারার কারণে শিক্ষায় ধনী-গরিবের একটি বৈষম্য রয়েছে বলে মন্তব্য করেন এ শিক্ষাবিদ। তিনি বলেন, ‘এটি কাটিয়ে উঠতে পরিকল্পনা প্রয়োজন। যেসব শিক্ষার্থী ক্লাসে পিছিয়ে আছে তাদের জন্য বিদ্যালয়ের উদ্যোগেই কোচিং, অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করা উচিত। প্রয়োজনে এ কোচিং বা অতিরিক্ত ক্লাসের জন্য পৃথক শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে।’