রবিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৫

পাঁচ দশকে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়েছে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস

টিএনসি ডেস্ক

প্রকাশিত: : এপ্রিল ২৬, ২০২৫, ০৩:৩০ পিএম

উচ্চ তাপে ভেঙে পড়তে পারে জনস্বাস্থ্য, কৃষি উৎপাদন ব্যাহতের শঙ্কা

পাঁচ দশকে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়েছে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস

১৯৭৬ সালে দেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছিল ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এরপর ২০২৩ ও ২০২৪ সালে তা ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়ায়। ফলে পাঁচ দশকের বেশি সময়ের ব্যবধানে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়েছে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। চলতি বছরও তাপমাত্রা বাড়ার প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণেই এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে। তবে বৈশ্বিক গড়ের তুলনায় বাংলাদেশে তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার তুলনামূলক বেশি, যা জনজীবন ও কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। উচ্চ তাপমাত্রা অব্যাহত থাকলে জনস্বাস্থ্য বড় ধরনের সংকটে পড়তে পারে।

কানাডার ইউনিভার্সিটি অব অটোয়ার এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ও ৫৭ শতাংশ আর্দ্রতায় টানা ৯ ঘণ্টা অবস্থান করলে অধিকাংশ মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে। কেউ টানা ৯ ঘণ্টা থাকতে পারেনি, আর যারা কিছুক্ষণ longer ছিল তাদের মধ্যে বমি, ডায়রিয়া ও ডিহাইড্রেশনের মতো সমস্যা দেখা দেয়।

দেশে বিগত কয়েক বছরে তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকিও উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। হিট স্ট্রোক, ডায়রিয়া ও পানিশূন্যতার মতো রোগের প্রকোপ বেড়েছে। রাজধানী ঢাকার মতো জনবহুল শহরগুলোতে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়ছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী জানান, প্রকৃতি ও মানুষের ভারসাম্য নষ্ট হলে মানুষের স্বাস্থ্যও হুমকির মুখে পড়ে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে নানা নতুন রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছে, যা অতীতে বিরল ছিল। তিনি আরও বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণতার পাশাপাশি স্থানীয় পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণেও বাংলাদেশের ইকোসিস্টেমের ভারসাম্য মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

বিশ্বব্যাংকের ২০২৩ সালের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৮০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে দেশে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়েছে ৫ ডিগ্রির বেশি। দক্ষিণাঞ্চলে তাপমাত্রা বেড়েছে সবচেয়ে বেশি—৫ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। উত্তরাঞ্চলে বেড়েছে ৪ দশমিক ৯ ডিগ্রি এবং ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় বেড়েছে ৪ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। একই সময়ে গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

পরিবেশবিদরা বলছেন, ঢাকায় তাপমাত্রা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ নগরায়ন, সবুজ এলাকা ও জলাশয়ের কমে যাওয়া এবং অতিমাত্রায় কংক্রিটের আচ্ছাদন। নগর উন্নয়নে পরিবেশবান্ধব নকশার অনুপস্থিতি, ইটভাটা, কলকারখানা ও যানবাহন থেকে নির্গত দূষণ নগরীর তাপমাত্রা আরও বাড়িয়ে তুলছে। ফলে প্রকৃত তাপমাত্রা ৩৪-৩৬ ডিগ্রি হলেও অনুভূত হয় ৪০-৪২ ডিগ্রির মতো।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এপ্রিল মাসে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে চুয়াডাঙ্গায়, ৩৯ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বর্তমানে দেশের সাতটি জেলায় তাপপ্রবাহ চলছে, যা আজও অব্যাহত থাকতে পারে। তবে আগামী সপ্তাহের শুরুতে বৃষ্টি হতে পারে, যা তাপমাত্রা কিছুটা কমাতে পারে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মনিরুজ্জামান জানান, নগর এলাকায় ইটভাটা, কলকারখানা, বায়ুদূষণ ও বর্জ্য পোড়ানোর কারণে মানবসৃষ্ট গরমের অনুভূতি বেড়ে যাচ্ছে। ফলে প্রকৃত তাপমাত্রার তুলনায় ৫-৭ ডিগ্রি বেশি গরম অনুভূত হয়। তিনি সতর্ক করেন, দ্রুত উদ্যোগ না নিলে বাংলাদেশের অনেক এলাকা মরুভূমির মতো হয়ে উঠতে পারে।

পরিবেশবিদরা বলছেন, ঢাকায় অতিমাত্রায় কংক্রিটের আচ্ছাদন, সবুজ এলাকা ও জলাশয়ের সংকট, অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ এবং বায়ুদূষণের কারণে তাপমাত্রা বেড়েছে। আগে শহরে যে পরিমাণ জলাশয় ও সবুজ ছিল, তা অনেকটাই হারিয়ে গেছে। নগর কর্তৃপক্ষ কিছু উদ্যোগ নিলেও সমস্যা সমাধানে আরও পরিকল্পিত ও কার্যকর পদক্ষেপের প্রয়োজন।

তাপমাত্রা বৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে কৃষিতেও। কৃষি বিশেষজ্ঞরা জানান, তাপপ্রবাহের কারণে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে, ফলে গাছের গোড়ায় পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ করা কঠিন হয়ে পড়ছে। এতে ফল ও ফসলের ক্ষতি হচ্ছে। বোরো ধান, আম, লিচু, কাঁঠাল, জামরুলসহ বিভিন্ন ফল ও ফসল ঝরে পড়ছে। বিশেষ করে বোরো ধানে হিট শকের কারণে ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

পরিবেশ ও বন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ঢাকায় অতিমাত্রায় কংক্রিটের ব্যবহার এবং সবুজ ও জলাশয় কমে যাওয়ার ফলে তাপমাত্রা সহনীয় থাকার পরিবর্তে আরও বেড়েছে। এ অবস্থা মোকাবেলায় স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ প্রয়োজন। আপাতত ওয়ার্ক ফ্রম হোম, স্কুল বন্ধ রাখা, রাস্তায় সুপেয় পানির ব্যবস্থা করার মতো উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। তবে দীর্ঘমেয়াদে ঢাকাকে সবুজায়ন ও বিকেন্দ্রীকরণের দিকেই অগ্রসর হতে হবে বলে তিনি মত দেন।

Link copied!