প্রকাশিত: : অক্টোবর ১, ২০২৫, ১১:০১ পিএম
ছবি: দ্য গার্ডিয়ান
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গাজা শান্তি পরিকল্পনা নিয়ে ২০ দফার একটি প্রস্তাবনা প্রকাশ করেছেন দুইদিন আগে; যা বিশ্বজুড়ে আলোচনার বিষয়বস্তু এখন। এই প্রস্তাবনা ঘোষণার পরপরই জর্ডান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, তুরস্ক, সৌদি আরব, কাতার ও মিশরের পররাষ্ট্রমন্ত্রীগণ যখন ট্রাম্পের এই প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানিয়ে যৌথ বিবৃতি দিলেন, স্পষ্টই বোঝা গেল- পর্দার আড়ালে আগেই পারস্পরিক আলাপ সম্পন্ন হয়েছে এবং সম্ভবত সর্বসম্মতিক্রমেই এই প্রস্তাবনা তৈরী হয়েছে। ট্রাম্পের ঘোষণার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে পৃথিবীকে জানানো হলো মাত্র।
এই প্রস্তাবের কোনো পক্ষে ফিলিস্তিন বা বিশেষত গাজার প্রতিনিধি হিসেবে কারো অন্তর্ভুক্তি নাই। বাইরের এক দল মানুষ মিলে ঠিক করছে গাজা কীভাবে চলবে। যার সারকথা হচ্ছে, গাজা নামক বন্দি উপত্যকাটি এখন আর উক্ত জনগণ পরিচালনা করবে না। গাজা পরিচালিত হবে একটি অন্তর্বর্তীকালীন কমিটি দ্বারা, যার তদারকি করবে সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের নেতৃত্বে গঠিত একটি শান্তি পরিষদ। সে শান্তি পরিষদের প্রধান তত্ত্বাবধায়ক হবেন স্বয়ং ডোনাল্ড ট্রাম্প।
টনি ব্লেয়ার ইরাকী জনগণের উপর একটি অন্যায় যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়ে দেশটিকে ধংসস্তূপে পরিণত করার মূল কারিগরদের একজন। কয়েক মাস আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প গাজার সব মানুষকে অন্যত্র সরিয়ে দিয়ে সেখানে একটি অভিজাত পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার যে পরিকল্পনার কথা বলেছিলেন, জানা যায়- সেটি এসেছিল টনি ব্লেয়ারের পরামর্শেই। সেই টনি ব্লেয়ারকেই প্রস্তাব করা হয়েছে গাজা দেখভালের জন্য গঠিতব্য শান্তি পরিষদের প্রধান হিসেবে। পরিহাসের কী আর বাকি থাকে!
প্রকৃতপক্ষে এর মাধ্যমে গাজাতেও পশ্চিম তীরের মতো আজ্ঞাবহ একটা প্রশাসন তারা চায়, যারা শুধু নতমস্তকে ইসরায়েলের সুবিধামতো নীতি-কৌশল গ্রহণ করে ওই অঞ্চলটিকে পরিচালনা করবে। বলা হচ্ছে, একটি আন্তর্জাতিক বাহিনী সেই আবদ্ধ উপত্যকার নিরাপত্তা বিধান করবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, সে বাহিনী গাজার নয়, মূলত গাজার দিক থেকে ইসরায়েলের যেন সামান্য কোনো ক্ষতিও না হয়- সেটিই নিশ্চিত করবে।
পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কোনো সামরিক বাহিনী নেই। নতুন প্রস্তাবে গাজারও সকল সামরিক সক্ষমতাকে আত্মসমর্পণ করতে হবে। ইসরায়েল পশ্চিম তীরে যখন যেখানে ইচ্ছা ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে বসতি বানাচ্ছে, যার-তার ঘরে গিয়ে রেইড দিচ্ছে, রাস্তা-ঘাটে চেকপোস্ট বসাচ্ছে, আটক করছে। একই কাজ গাজায় করার ‘বৈধ’ অনুমতি তারা পাবে এর মাধ্যমে। হয় নিজেরা গিয়ে করবে অথবা সে আন্তর্জাতিক বাহিনী ‘নিরাপত্তার স্বার্থে’ তাদের হয়ে করে দিবে। এই পুরো প্রস্তাবে গাজার মানুষের প্রতি দরদের কোনো স্থান নাই।
মূলত ইসরায়েলের ক্রমাগত যুদ্ধাপরাধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের জেরে বিশ্বব্যাপী যে নিন্দামন্দের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে, তা থেকে মুখরক্ষা করার একটা ঢাল হিসেবে এটি সামনে আনা হয়েছে। যে নৈতিক পরাজয়ের মুখে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র মধ্যপ্রাচ্যের শাসকগণ পড়েছে, তা থেকে উদ্ধারের জন্যই এই নতুন নড়াচড়া; যেন বলতে পারেন– তারা গাজার জন্য ‘কিছুই না করে’ বসে নেই, সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য খুবই বড় কাজ করছেন। তারই দুর্বল একটি চেষ্টামাত্র এই প্রস্তাবনাকে স্বাগত জানিয়ে একসাথে কাজ করার ঘোষণা দেওয়া। এই প্রস্তাবনা বাস্তবায়িত হলে, ইসরায়েল ও তার মিত্ররা ‘বৈধভাবে’ গাজাকে শাসন করার অধিকার পেয়ে যাবে। একে সংঘাতের অবসান হিসেবে দেখিয়ে সৌদি আরব আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার দিকে এগুতে তখন আর কোনো বাধা থাকবে না।
ট্রাম্পের সাথে একান্ত দহরম-মহরম চলতে থাকা পরমাণু শক্তিধারী একমাত্র মুসলিম দেশ পাকিস্তানও তখন দখলদার দেশটিকে স্বীকৃতি দিতে কোনোপ্রকার নারাজি দিতে পারবে না। সফলভাবে সম্পন্ন হবে কয়েকবছর আগে ঘোষিত ‘আব্রাহাম একর্ডস’। ট্রাম্প তখন প্রকৃত অর্থেই নোবেল শান্তি পুরস্কারের দাবিদার হয়ে ওঠবেন। এই প্রস্তাবের মূল লক্ষ্য ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। মহাশক্তিধর ইসরায়েল যে অল্প একটু আঁচড় সহ্য করতে হয় গাজা থেকে, সেটিও যেন চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়- তারই বন্দোবস্ত করা হচ্ছে।
ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্থাপন যেন নিঃশঙ্কোচ ও স্বাভাবিক হয়, সে পথটিকে মসৃণ করার বিস্তারিত পথনকশাই বিধৃত হলো এতে। তাইতো পুরো গাজা উপত্যকাকে বিরান করে দেওয়া, হাজার হাজার মানুষকে ‘সরাসরি সম্প্রচার’ করে হত্যা করে ফেলার বদলা তো দূর, অন্তত বিচারের কথাটাও উচ্চারিত না হয়ে, গাজাকে বলা হচ্ছে সুবোধ বালকটি হয়ে যেতে। যেন সকলে মিলে দান-দক্ষিণা করে ‘মহান দানবীর’ হিসেবে নিজেদের উপস্থাপন করতে পারে। এই প্রস্তাবনার কোথাও নাই এই ভূমির মানুষদের স্বাধীকারের কথা। কোথাও নাই এই আন্তর্জাতিক বিশ্বের, জাতিসংঘেরই নির্ধারণ করে দেওয়া দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের ভিত্তিতে পূর্ব সীমানা প্রতিষ্ঠার কথা।
ইসরায়েল কর্তৃক অবৈধভাবে দখলকৃত ফিলিস্তিনি ভূমি ফেরতের কোনো কথা নাই। কোথাও নাই দখলদার শক্তিটির জবাবদিহিতার কথা। মাঝে মাঝে মনে হয়, সেখানে হয়তো কিছুই হচ্ছে না। সবাই স্বাভাবিক-সাধারণ জীবন-যাপন করছে। বীভৎস ছবি-ভিডিও যা আসে, তা সম্ভবত গুটিকয়েক মানুষের ভাগ্য। নাহয় একটা পুরো উপত্যকাকে এভাবে দিনের পর দিন বিরান করে দেওয়া হচ্ছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যে পরিমাণ বোমা ফেলা হয়নি, তার চেয়েও বেশি বোমা ফেলা হয়ে গেছে ইতোমধ্যে– এতকিছুর পরেও পুরো বিশ্ব, গোটা মানবজাতি কীভাবে এত নির্বিকার বসে থাকে! এভাবে দৌড়তে দৌড়তে মরতে থাকাই কি তাদের নিয়তি? এভাবেই পৃথিবীর বুক থেকে মিশে যাবে এই উপত্যকাটির নাম?
নতুন প্রস্তাবনা বাস্তবায়িত হলে বেঁচে থাকা অবশিষ্ট লোকজনের প্রাণ হয়তো রক্ষা পাবে। এরপর আসবে তাদের জন্য ইসরায়েলি প্রেসক্রিপশনে শিক্ষাব্যবস্থা। গাজার মানুষের প্রতিরোধ স্পৃহাকে নষ্ট করে দেওয়ার সবরকমের চেষ্টা হবে। দীক্ষা দেওয়া হবে ইসরায়েল কর্তৃক শাসিত হওয়াকে নিও-নরমাল হিসেবে মেনে নিতে। রুটি-কাপড়ের বিনিময়ে ছিনিয়ে নেওয়া হবে তাদের ঈমান।
কিন্তু ইতিহাস বলে, প্রতিরোধস্পৃহার কখনো মৃত্যু হয় না। ফাতাহ বা পিএলও যখন অস্ত্র সমর্পণ করে সুবোধ বালকে পরিণত হলো, পশ্চিম তীরে কি সাহসী যুবকের দল (সশস্ত্র গেরিলা গোষ্ঠী) উঠে দাঁড়ায়নি? আজকে যে শিশুরা তাদের বাবা-ভাই ও মা-বোনকে ছিন্নভিন্ন দেহে পড়ে থাকতে দেখেছে, তাদেরকে কি সহজেই ভুলিয়ে দেওয়া যাবে সবকিছু? এই ছাই, এই ধ্বংসস্তুপের মধ্য থেকেই একদিন আবার উঠে আসবে নতুন কোনো প্রতিরোধ যোদ্ধা। ফলে আজকে যদি গাজার মানুষের জীবনের চিন্তা করে হামাস শর্তগুলো মেনেও নেয়, ভবিষ্যতে নতুন কোনো সংগঠন তৈরী হবে।
ইসরায়েলের বন্ধুরা তার নিরাপত্তা বিধানে যত কসরতই করুক, ঘুরেফিরে বারবার তার উপর প্রতিরোধের আঘাত পড়বেই। অবশ্য শর্ত না মানলে, হামাস আত্মসমর্পণ না করলেও যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের ক্ষতি নেই। তখন তারা পূর্নমাত্রায় খোলা হাতে ইসরায়েলকে চলমান গণহত্যায় সমর্থন ও সহায়তা দিতে পারবে, ‘হামাস শান্তি চায় না’ এই অযুহাতে। একদম মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়ার উপলক্ষ পাওয়া যাবে তখন। অর্থাৎ এই প্রস্তাবনা গ্রহণ করা বা না করার উপর তাদের অভীষ্ট লক্ষ্য পৌঁছানো নির্ভর করছে না। গাজার মানুষদের ‘ঈমান’ ও স্পৃহা বিক্রি হবে না। কিন্তু মুসলিম শাসকদের বিকিয়ে যাওয়া আত্মসম্মানের নিশানা ইতিহাসে থেকে যাবে।
ইসরায়েলের সাথে প্রকাশ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরীর কূটকৌশল হিসেবে তারা যা করছে, তার কর্মফল তাদের জন্য খুবই ভারি হবে। তাদের মিত্র বা ‘বড় ভাই’-ই হয়তো তাদেরকে গিলে খাওয়ার এন্তেজাম করবে একদিন; পরম ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েলকে আরো বড় করতে কিংবা তাকে আরো নিরাপদ করতে। সে দিনটি না আসুক, সে কামনাই রইল। কিন্তু নিয়তির লিখন কী করে খণ্ডন করা যায়, তা নিশ্চয় কারো জানা নেই?