প্রকাশিত: : জুলাই ১০, ২০২৫, ১২:৩৫ এএম
খোমেনী এহসান-
বাংলাদেশের রাজনীতির ভেতরে যে খেলা চলে তা অনেকটাই বলে দেওয়া সম্ভব যদি আপনি খেলোয়াড় চেনেন। ধরেন আপনি জানেন কে লিওনেল মেসি, কে রোনালদো আর কে ক্রিস গেইল, কে আফ্রিদি, তাহলে খেলাটা ফুটবল না ক্রিকেট চোখ বুঝে বলতে পারবেন।
আমি ইদানিং বেশ কয়েকজনের মুখে নুরুল ইসলাম ভূইয়া ছোটনের নাম শুনেছি। তার নানা ভূমিকার কথা লোকজন বলছে। কিন্তু তার পরিচয় জিজ্ঞেস করলে বিস্তারিত বলতে পারছে না।
আমার ফেসবুকে থাকা একটু অগ্রসর লোকজনও হয়তো ছোটনের কথা শুনে থাকবেন। কিন্তু ওনার খুব সাধারণ কিছু পরিচয় আপনারা জানেন না।
কয়দিন আগে যে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী মারা গেলেন, ওনার ভায়রা হলেন ছোটন৷ মানে শিরিন হকের বোন নাসরিন হকের স্বামী।
স্রেফ এই পরিচয়টুকু ধরে টান দিলে এবি পার্টি, জামায়াত, গণঅধিকার, চরমোনাই, হেফাজত, ডিজিএফআই, ফরহাদ মজহার, পিনাকী, মঞ্জু, তাহের, মেসবাহ সাঈদসহ কত কিছু যে বের হয়ে আসবে। তারপর ধরেন ওয়ান ইলেভেন, চার দলীয় সরকার, ভারত, প্রথম আলো পর্যন্ত চলে আসবে।
এত কিছু যে আসবে তার জন্য অবশ্যই আপনাকে নেটওয়ার্ক ও সমীকরণ বুঝতে হবে।
সেই সব আলাপের আগে আমার প্রশ্ন এটাই যে যারা ছোটনকে চিনেন তারা কতজন আগে জানতেন যে উনি ডা. জাফরুল্লাহর ভায়রা?
মূলতঃ আপনারা বাংলাদেশকে তার ভেতর থেকে বুঝতে সম্পর্কগুলোই ঠিক মতো উদ্ঘাটন করতে পারেন না।
একে একে অনেকগুলো পর্ব লেখব।
দুই.
ভয়ঙ্কর কুচক্রী একজন মানুষ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ক্লাস না করলেও আমার অভ্যাস ছিল নিয়মিত কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির রেফারেন্স সেকশনে যাওয়ার। সেখানে বাংলাদেশের অনেকের ইয়াং বয়সের কাজকর্ম পড়তাম। এরমধ্যে একটা জায়গায় প্রথম ছোটনের নাম জানতে পারি।
ঘটনাটি বেশ চমকপ্রদ। এখন যে সচিবালয়ের চারপাশে বিশাল ঊঁচু দেয়াল দেখেন তা আগে এমন ছিল না। বুক পর্যন্ত উঁচু দেয়াল ছিল।
কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসে একবারই ওই দেয়াল টপকে সচিবালয়ে ঢুকে পড়েছিল কৃষক ও শ্রমিকরা৷ তারা অফিসারদের পিটিয়ে কাপড় ছিড়ে ফেলে।
ঘটনাটি হলো এরশাদকে হটাতে বিএনপি, লীগ ও বামপন্থীরা তিন দিক থেকে সচিবালয় ঘেরাও করে৷ হঠাৎ গুজব ছড়িয়ে পরে খালেদা জিয়াকে (১৮ বছর আগের স্মৃতি, হয়তো শেখ হাসিনা) গ্রেপ্তার করা হয়েছে৷ এ খবর শুনেই ঘেরাওয়ে আসা শ্রমিক ও কৃষকরা লাঠিসোঁটা নিয়ে সচিবালয়ে ঢুকে পড়ে।
পরে জানা গেল, এরকম কিছু হয়নি। বরং তৎকালীন ওয়ার্কার্স পার্টি নেতা ছোটন এই মিথ্যা খবর প্রচার করেছে।
নুরুল ইসলাম ভূইয়া ছোটনকে নিয়ে পুরনো পত্রিকার ওই রিপোর্টের কথা পরবর্তীতে বহু সময় আমাকে ভাবিয়েছে। ছোটন কিভাবে কুচক্রী হিসাবে কাজ করে তা বুঝতে গেলেই তার এ অতীতের কথা মনে পড়ে যায়।
তিন.
মূলতঃ নুরুল ইসলাম ভূঁইয়া ছোটনকে নিয়ে আশির দশক থেকেই রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক শুরু হয় তার কুচক্রী ভূমিকার কারণে।
বিশেষ করে তার বিরুদ্ধে সেনা গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে আঁতাত থাকার অভিযোগ ওঠে।
ছাত্র আন্দোলন, তিন জোটের আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করা, ভুল তথ্য প্রদান ও একের বিরুদ্ধে অপরকে লাগানোর নানা ঘটনায় ছোট হয়ে পড়েন চরম বিতর্কিত।
মজার ব্যাপার হলো গত চার দশকে তার নামে থাকা অভিযোগগুলো আর অভিযোগে সীমিত নাই।
বরং নানা ঘটনাচক্রে রাজনৈতিক ও সাংবাদিক মহলে এটি সুবিদিত যে ছোটন আসলে কী বা কেমন।
ছোটনের ছোবল ও বিএনপি
২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর কিভাবে ভারতপন্থীরা হাওয়া ভবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় তার কাহিনী শুনেছিলাম দেশ রূপান্তরের প্রয়াত সম্পাদক অমিত হাবিবের মুখ থেকে।
মানে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর হাওয়া ভবনের সঙ্গে ভারতের সংযোগটি ঘটেছিল সেখানকার শিল্পীদের নিয়ে ঢাকায় পারফর্ম করাকে কেন্দ্র করে। একাজে সহযোগিতা করে ছোটন ও তার সহযোগীরা। এরাই আবার বিএনপির সবচেয়ে বড় মিডিয়া প্রজেক্ট যায়যায়দিনে আশ্রিত হয় এবং তাদের কার্যক্রমের পুরোটা শুধু জাতীয়তাবাদ বিরোধী ছিল এমন নয়, বরং ২০০৬ সালের অক্টোবরে বিএনপি বিরোধী যে ডিজিএফআই প্রযোজিত আক্রমণ তার শুরুটা তারাই করে৷
এই পুরো ঘটনাটি বুঝতে গেলে আমাদের আরও পেছনে যেতে হবে। অন্য অনেক বামপন্থীর মতো ছোটনও এক সময় বিএনপিতে ভিড়ে যায়৷ কিন্তু আদর্শিকভাবে তাদের এজেন্ডা ইসলামী মূল্যবোধ ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ বিরোধীই থাকে।
ছোটন বিএনপিতে জায়গা করতে সিনিয়র সাংবাদিক শফিক রেহমানের সঙ্গে ভিড়ে যান। ১৯৯৮ সালে সাপ্তাহিক যায়যায়দিন দৈনিকে রূপান্তরিত হলে তাতে যোগ দেন ছোটন৷ কথিত আছে ছোটনের কারণেই যায়যায়দিন প্রতিদিন অকালে বন্ধ হয়ে যায়।
পরে অনেক বছর লাগিয়ে ২০০৬ সালে যায়যায়দিন প্রকাশিত হলে তাতে নির্বাহী সম্পাদক হন তিনি। এর মালিকানায় শেয়ার ছিল তার। তবে যায়যায়দিনের ফিন্যান্স ছিল রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের এক জঘন্য উদাহরণ। পত্রিকাটির সিংহভাগ মালিক ছিলেন শফিক রেহমান, কিন্তু তার কোনো বিনিয়োগ ছিল না, এমন ছোটনেরও ছিল না। সরকারি খাস জমি আর ভূমিদস্যু বসু্ন্ধরার পয়সা ছিল যায়যায়দিনের অর্থের উৎস।
এরমধ্যে ছোটনের কারিশমা হলো, ভাববাদী শফিক রেহমানকে সামনে রেখে গোটা যায়যায়দিনের নিয়ন্ত্রক হয়ে যায় নুরুল ইসলাম ভূঁইয়া ছোটন। পত্রিকাটির রিপোর্টিং ও ডেস্কে নিয়োগ পায় ছোটনের অনুগতরা। শফিক রেহমান মূলতঃ ফিচার ও সম্পাদকীয় বিভাগের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতেন। যায়যায়দিনে কী রিপোর্ট হবে না হবে সম্পাদক হয়েও তার কিছুই তিনি জানতেন না।
মজার ব্যাপার হলো, শফিক রেহমানকে তার প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা থেকে সরিয়ে দিতে ছোটনকে নিয়মিত কুমন্ত্রণা দিতেন ফরহাদ মজহার ও ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীরা।
এক্ষেত্রে ছোটনের কৌশল ছিল চমকপ্রদ। হুমায়ুন কবির সাব্বির নামে বসুন্ধরা গ্রুপের এক পরিচালককে হত্যা করে গ্রুপটির চেয়ারম্যান শাহ আলম ওরফে আহমেদ আকবর সোবহানের দুই ছেলে সাফিয়াত সোবহান এবং সাদাত সোবহান।
ওই ঘটনার জেরে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার বসুন্ধরার বিরুদ্ধে লাগাতার রিপোর্ট করে। তখন শাহ আলম আশা করে যে তাদের অর্থায়নে পরিচালিত যায়যায়দিনে তাদের পক্ষে রিপোর্ট করবে৷ কিন্তু ছোটন বসুন্ধরার পক্ষে কোনো রিপোর্ট না করে এর দায় চাপান শফিক রেহমানের ওপর। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে বসুন্ধরা যায়যায়দিনের সাংবাদিকদের বেতন ভাতা, নিউজ পেপার ও প্রেসের কালি বন্ধ করে দেয়।
কার্যত পয়সাহীন শফিক রেহমান এতে বিপদে পড়ে যান। এদিকে হাওয়া ভবনকে দিয়ে বসুন্ধরাসহ ফাঁদ পাতেন ছোটন। আর তাহলো শফিক রেহমানকে বাদ দিয়ে ছোটনের দখলের যাবে যায়যায়দিন, তখন বসুন্ধরাও টাকা দেবে। বিপদ টের পেয়ে শফিক রেহমান যায়যায়দিন থেকে গোটা ছোটন বাহিনীকে অব্যাহতি দেন এবং তিনি লন্ডনে গিয়ে নিজের বাড়ি বিক্রি করে টাকা এনে যায়যায়দিন চালাতে উদ্যোগী হন।
এই সময়টাতে এসে দেখা যায় বিএনপির ভেতরেই বাসা বেধে আছে এক অপশক্তি যারা কাউকেই তোয়াক্কা করত না। বরং ওয়ান ইলেভেন ঘটাতে ভেতরে ভেতরে এক নেটওয়ার্ক বিস্তার করে বসে আছে। ফলে খোদ প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বক্তৃতা লেখক শফিক রেহমানকে বেআইনীভাবে বিমানের বোর্ডিং অবস্থায় নামিয়ে আনা হয়। এটি সম্ভব হয় ছোটনের উদ্যোগে ডিজিএফআইয়ের কারসাজিতে।
তবে শফিক রেহমানের দৃঢ়তায় যায়যায়দিন ছোটন দখল করতে পারেনি। যদিও পরবর্তীতে মঈন উ আহমদের রোষাণলে পড়ে শফিক রেহমান পত্রিকাটি ডিজিএফআই নেটওয়ার্কের ব্যবসায়ী সাঈদ চৌধুরী তথা এইচআরসি গ্রুপকে লিখে দিতে বাধ্য হন। সাঈদের পরিচয় হলো তিনি আওয়ামী লীগ নেতা সাবেরের ভাই।
চার.
নুরুল ইসলাম ভূঁইয়া ছোটন মানুষ হিসাবে কেমন এবং নিজেদের টার্গেটে পৌঁছাতে কতটা আগ্রাসী তার আদর্শ প্রমাণ হলো ফরহাদ মজহারের গুমের ঘটনায় তার ভূমিকা।
২০১৭ সালের ৩ জুলাই ভোর ৫টা ৫ মিনিটে শ্যামলীর হক গার্ডেনের বাসা থেকে বের হন ফরহাদ। চোখের ওষুধ কেনার জন্য বের হয়েছিলেন বলে দাবি করেছিলেন তিনি ও তার পরিবার। মূলতঃ কড়াইল বসতির উদ্দেশ্যে এক গর্ভবতী হিন্দু তরুণীর উদ্দেশ্যে বের হন। ওই সন্তান ছিল ফরহাদের। তাকে গর্ভপাত করতে রাজি করাতে ও হাসপাতালে ভর্তির টাকা দিতেই ভোর বিহানের এ যাত্রা ছিল।
কিন্তু ফরহাদ মজহারসহ অনেক ভারত বিরোধীই র`র নজরদারিতে ছিল। তাদের ফোন রেকর্ড থেকে শুরু করে গোপন অভিসারের সব কিছুই ছিল তাদের নখদর্পনে।
তবে ফরহাদ মজহারকে অনেকের নিরাপত্তাই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে দেয়া হয়। এর নেপথ্যে বিদেশী কানেকশনের ব্যাপার আছে।
ফলে ফরহাদ তার বাসা থেকে বের হওয়া মাত্র তাকে র` তুলে নেওয়ার পরপরই ফরহাদের পরিবার সব জেনেও চুপচাপ থাকলেও সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে ঘটনাটি মিডিয়ায় আনা ও তাকে উদ্ধারে র্যাবকে মাঠে নামানোর ঘটনা ঘটে।
ফরহাদ গুম হওয়ার পরে তার গুমের খবরটি প্রথম প্রকাশিত হয় এমন একটি অনলাইনে যার দায়িত্বে ছিলেন সেই সাংবাদিক যিনি বিএনপি জামাত সরকারের সময় বাংলাদেশে বামপন্থী কমিউনিস্টদের ক্রসফায়ারের ঘটনা গুলো সবার আগে জানতেন, তিনি একাত্তরে পাকিস্তানে থাকা এক সেনা সদস্যের সন্তান।
মূলতঃ সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপে ফরহাদ মজহারকে সীমান্তের ওপারে নেওয়া র`র পক্ষে অসম্ভব হয়ে যায়। কিন্তু দেশেও র`র পক্ষে কাউকে হেনস্থা করার সুযোগ ছিল। ফলে ফরহাদকে র্যাব উদ্ধার করলেও তাদের থেকে তাকে পুলিশ এক প্রকার ছিনিয়ে নেয়, যার আইনী মুখোশ ছিল হস্তান্তর করা হয়। আর পুলিশ তাকে হাতে পেয়ে র`র কথামতো খুলনার মার্কেটে ঘুরতে বাধ্য করা, গর্ভবতী হিন্দু নারীকে বিকাশ করা, স্ত্রী ফরিদা আখতারকে ফোন করে ৩৫ লাখ টাকা যোগার করতে বলা এবং গফুর নামে হানিফ পরিবহনের বাসের টিকিট কেটে বাসের উদ্দেশ্যে রওনার ঘটনা ঘটে।
আমি ফরহাদ মজহারের গুম থেকে উদ্ধার পর্যন্ত প্রতি মুহূর্তেই ফেসবুকে লিখেছি৷ আলতাফ পারভেজ ভাই এনিয়ে আমাকে ধন্যবাদও দিয়েছিলেন।
তবে আমি যখন ফরহাদ মজহারকে গুমের বিষয়ে পুলিশের সাজানো নাটককেও তুলোধুনো করছিলাম, তখন ইন্টারেস্টিং ঘটনা ঘটে। ফরহাদের শিষ্য মোহাম্মদ রোমেল আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে তার পক্ষে লেখালেখি বন্ধ করতে বলেন। বিষয়টা আমার জন্য ছিল শকিং। তিনি বলার পরেও মনে হয় আরও দু একটা স্ট্যাটাস লেখছি। তারপর আমার ঘনিষ্ঠ এক কবিও যোগাযোগ করলেন। আমরা উভয়েই রোমেলের বাসায় রহস্য জানতে আমন্ত্রিত হলাম।
তারপর সেখানে গিয়ে রোমেলের কাছ থেকে শুনলাম যে ফরহাদের পুরা ঘটনাতেই নাকি ভেজাল। বস্তিতে গিয়ে হিন্দু মেয়ের সঙ্গে সেক্স করার ঘটনা সত্য। কড়াইল বস্তির অনেক দূরে গাড়ি রেখে হেঁটে যেতেন। ফরিদা আখতারের বিদেশ ভ্রমণের সময় এটি ঘটে। রোমেলের দাবি হলো, ফরহাদের এরকম ঘটনা অসংখ্য। এসব নিয়ে ঝামেলা হয় ফরিদ আখতারের সঙ্গে, তখন গৌতম দাশ সহ ইনার সার্কেলের লোকেরা মিটমাট করে। রোমেল জানাইল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার এক মেয়েকে সে পটিয়েছিল, কিন্তু ফরহাদ কুষ্টিয়ার লালন আখড়ায় সেই মেয়েকে হিপটোনাইজ করে সেক্স করে ফেলে। ওই মেয়ে প্রথমে এটাকে দেহতাত্ত্বিক সাধনা মনে করেছিল, কিন্তু সেক্স করার পর সে মনে করছে রেইপড হইছে এবং এ নিয়ে তার মানসিক সমস্যা হয়।
আমি যখন ঢাকায় তরুণ সরকার, পিনাকী রায়, মুন্নীসাহাদের সার্কেলে মিশতাম, এটা ২০০৪/৫ সালের কাহিনী, তখনো ফরহাদ মজহারের যৌনবিকারের কথা শুনি, কোনো এক বিদেশী মেয়ের বেলায় এমনটা ঘটেছিল।
কিন্তু বামপন্থীদের ভেতরকার যৌনতা সংক্রান্ত নানা আলাপ সত্ত্বেও আমাদের তরুণ জীবনে তাদের সঙ্গে চলাফেরা ছিল। ফরহাদ মজহারের সঙ্গে বলা যায় ২০১৬ পর্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলাম। কাটায় কাটায় ১২ বছর! তার ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা ও বিকার নিয়ে আগ্রহী ছিলাম না এসব জানতে ফুসুরফাসুরেও জড়াইনি।
কিন্তু রোমেল যখন গুমের ঘটনা সূত্রে সব টান দিলেন তখন পুরনো নানা কথা মনে পড়েছিল।
রোমেল তখন বলছিলেন, ফরহাদের নারী কেলেঙ্কারির বিষয়ে ছোটন, গৌতম দাশ, পিনাকী ভট্টাচার্যও নিশ্চিত জানেন, তাই তারা তার পক্ষে লেখা বন্ধ করে দিছে, শুধু আমিই একা ফরহাদ মজহারকে নিয়ে সোচ্চার। রোমেলরা চান আমি যেন লেখা বন্ধ করি।
রোমেল আমাকে থামাতে আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের প্রসঙ্গও আনে। ফরহাদ যে গুমের সময় ফরিদাকে ফোন করে বলেছিল অপহরণকারীরা ৩৫ লাখ টাকা চায়, সেই টাকাটা মাহমুদুর রহমান দিছিলেন, ফরিদাকে টাকাটা রাখতে বলেছিল ফরহাদ। রোমেল বললো পুরো নাটক সাজিয়ে মাহমুদুর রহমানের টাকা নিজেদের কাছে রেখে দিছে।
কথা হলো ফরহাদকে নিয়ে রোমেলরা যা বলেছে তা মোটেই নতুন নয় এবং অসত্যও নয়। ফরহাদের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ হলো যেসব গরিব হিন্দু নারীরা ধর্ম বদলে খৃস্টান হয়েছিল তারা উবিনীগে চাকরি করতে গিয়ে তার সঙ্গে যৌন সম্পর্কে জড়ান এবং ঘটনা জানাজানি হলে ফরিদা আখতারের সঙ্গে দেন দরবার হয়ে ভিক্টিমদের তাড়িয়ে দেয়। সামগ্রিক পরিস্থিতিতে গর্ভবতী হয়েও কোনো নারী ফরহাদের সন্তানের মা হতে পারে না বরং অকাল গর্ভপাত করতে হয়। রোমেল, গৌতম থেকে শুরু করে অন্য সব সাঙ্গপাঙ্গই আগে থেকে এসব কম বেশি জানে। তাহলে ফরহাদের গুমের ঘটনার সময় তার খাসলত ধরে টান দেওয়া কেন, এই প্রশ্নটি আমার মধ্যে ছিল।
পরবর্তীতে এর ব্যাখ্যা জাফরুল্লাহ ও ছোটনের ভূমিকা থেকে টের করেছি।
সেক্ষেত্রে দেখা যায়, ২০১৩ সালের পর সরকার বিরোধীদের মধ্যে ভারত বিরোধী অংশকে কোনঠাসা করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। মাঝখান থেকে এমন সব বিরোধী মুখকে সামনে আনা হয় যারা প্রচুর সরব থাকলেও ভেতরে ভেতরে বিরোধী মতের ইসলাম পছন্দ অংশটার চরম বিরোধী। এক্ষেত্রে তারা ইসলাম ও মুসলমান ইস্যুকেও কাজে লাগায় মূলধারার ইসলামপন্থাকে কোনঠাসা করতে। এই পুরো ঘটনাটা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, অধ্যাপক এমাজউদ্দীন, হেফাজত, মজিবুর রহমান মঞ্জু, গার্ডিয়ান প্রকাশনী চক্রদের মাধ্যমে ঘটে। যার মধ্যমণি হিসাবে আমরা নুরুল ইসলাম ভূঁইয়া ছোটনকে পাই।
আপনারা খেয়াল করলে দেখবেন জাফরুল্লাহ চৌধুরীরা আমৃত্যু সরব থাকলেও মাহমুদুর রহমানকে সব সময় এড়িয়ে গেছেন। আবার ফরহাদ মজহারও গুমের পর পরিত্যক্ত হয়েছেন। অথচ ইসলামপন্থাকে ঘিরে যে ভাঙাগড়া ছিল তার সব কিছুতে ফরহাদ মজহার ও মাহমুদুর রহমান সম্পৃক্ত ছিলেন। আমাদের আলোচনায় সামনে আসবে যে খোদ এবি পার্টি প্রজেক্টটাও ফরহাদ-মাহমুদের ছিল। কিন্তু ছোটনদের ম্যাকানিজমে তা হাত ছাড়া হয়।
এই ব্যাপারগুলানের জায়গা থেকে দেখলে ফরহাদের গুম নিয়ে ছোটনদের পল্টি নেওয়ার চালটা বোঝা যায়।
মানে চারিত্রিকভাবে স্খলিত বেকুব ফরহাদ মজহারকে গুম করতে গিয়ে ব্যর্থ হওয়ার পর র` যে ভাষ্য তৈরি করে তাকে ছোটনরা লুফে নিয়েছিল যাতে করে তাদের তৎপরতা সহজ হয়। সেক্ষেত্রে ফরহাদ মজহারের পাশে দাঁড়ানোর বদলে উল্টা তার বিরুদ্ধে লোক চক্ষুর অন্তরালে বড় প্রচারণা চালিয়েছিল।
এখানে বলা দরকার, ফরহাদ মজহারের বিরুদ্ধে পরবর্তীতে আমিও অবস্থান নিয়েছিলাম মূলতঃ ইসলাম বিকৃত করতে তার নানা লেখালেখির কারণে এবং কোথাও জায়গা না পেয়ে বামদের কাছে টানতে গিয়ে শাহবাগী ফ্যাসিবাদকে হাওয়া করে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়ায়, এবং সর্বশেষ ডিজিএফআইয়ের হয়ে জাতীয় ইনসাফ কায়েম কমিটি করার পর তাকে ছাড় দেওয়ার প্রশ্ন নাই।
পাঁচ.
এবি পার্টি যেভাবে ছোটনের খপ্পরে
জামায়াতের ভেতরে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যে ভুল চিন্তা ও মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রিক বিকার তৈরি হয়েছে তার অন্যতম কারিগর হলো আদর্শচ্যুত বাম ও ডিপ স্টেটের খেলোয়াড় নুরুল ইসলাম ভূঁইয়া ছোটন।
ছোটনের খপ্পরে পড়ে জামায়াতেরই একটি অংশ সংস্কারবাদী ইসলাম চিন্তা থেকে বিচ্যুত হয়ে মু্ক্তিযুদ্ধের চেতনার গোলামে পরিণত হয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে মূলতঃ ফরহাদ মজহারের একদল শিষ্যকে হাত করে তাদের দিয়ে জামায়াতের সংস্কারপন্থীদের মগজ ধোলাই করার মাধ্যমে।
ছোটনকে নিয়ে আমরা যে আলোচনা করছি তা ঠিকমতো বুঝতে ইসলামী সংস্কারপন্থীদের বিপথগামী হওয়ার ইতিহাসটা সবার কাছে স্পষ্ট হওয়া দরকার।
জামায়াতে ইসলামীতে সংস্কারবাদী চিন্তার উদ্ভব হয় মূলতঃ আমেরিকার ওয়ার অন টেররের নতুন ডাইমেনশন হিসাবে নির্বিচারে মুসলিম বিরোধিতার বদলে মুসলমানদের মধ্যকার উদারপন্থী আধুনিকতাবাদী লিবারেল একটা অংশকে কাছে টানার প্রকল্পের অংশ হিসাবে।
ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক হলেন বাংলাদেশের মডারেট লিবারেল ইসলামপন্থীদের গুরু, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার গভীর সখ্যতা ছিল, ঢাকা দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা তার বন্ধুও ছিলেন, আবদুল কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দেওয়ার পর র` চেষ্টা করেছিল আবদুর রাজ্জাককে গ্রেপ্তার করাতে। ধরতে পারলে তার ফাঁসি হতো। তবে গ্রেপ্তারের রাতের আগেই আমেরিকান এম্বাসির সরাসরি হস্তক্ষেপে আবদুর রাজ্জাক দেশ ছাড়তে সক্ষম হন।
অনেকেই জানে না যে আবদুর রাজ্জাকের সংস্কারপন্থা প্রোমার্কিন ছিল এবং তিনি তুরস্কের গুলেন মুভমেন্টের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।
অন্যদিকে জামায়াতের আরেক সংস্কারবাদী নেতা ছিলেন শহীদ আলী আহসান মুহম্মদ মুজাহিদ। তিনি তুর্কির ক্ষমতাসীন একে পার্টি দিয়ে প্রভাবিত ছিলেন।
জরুরি অবস্থার সময়, সম্ভবত, ১৬/১৭ বছর আগের ঘটনা, স্মৃতি থেকে বলছি, শহীদ মুজাহিদ তুর্কি সফর করে আসেন এবং তার সঙ্গে একে পার্টির গঠনতন্ত্র ছিল যা তিনি মিডিয়ায় প্রদর্শন করেন।
জামায়াতের এ দুই ধারার সংস্কারপন্থীদের মধ্যে শিবিরের নেতারা ছিল, যারা মূলতঃ ২০০৫ সালের শেষের দিক থেকে ঢাকার নাগরিক পর্যায়ে যাতায়াত করতে থাকে।
এদের মধ্যে আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল মূলতঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, মেডিকেল ও অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অআঞ্চলিক নেতারা৷ এদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় ছিল সাবেক সিপি জাহিদুর রহমান, শিশির মনির, মির্জা গালিব, যোবায়ের আহমেদ ভূঁইয়া, শাহ ফয়সাল রহমান প্রমুখরা।
অন্যদিকে শহীদ মুজাহিদপন্থী ছিল রফিকুল ইসলাম খান, শফিকুল ইসলাম মাসুদ, রেজাউল করিমরা।
তবে জামায়াত ও শিবিরের লোকদের মধ্যে একটা বড় ঘটনা হলো নয়াদিগন্ত পত্রিকা ও দিগন্ত টিভির আগমন।
এই দুই মিডিয়ার উদ্যোক্তা ছিলেন মীর কাসিম আলী। উনি ইসলামী ব্যাংকের দায়িত্বে ছিলেন৷ তখন শিবিরের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে ইসলামী ব্যাংকের সিএসআর থেকে টাকা দেওয়া হতো। সেই সূত্রে জামায়াতপন্থী লেখক কবি শিল্পিদের সঙ্গে তার গভীর খাতির তৈরি হয়।
নয়াদিগন্ত ও দিগন্ত প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর জামায়াত শিবিরের সাংস্কৃতিক কর্মীদের অনেকে চাকরি পায়। এবং সাবেক শিবির নেতারাও দুই মিডিয়া পরিচালনায় বিনা অভিজ্ঞতাতেও বড় দায়িত্বে চলে আসে।
আমার পর্যবেক্ষণ হলো, মীর কাসিম আলীর রিক্রুট লেখক সাংবাদিক ও শিবির নেতারা কর্মসূত্রেই লতায়পাতায় জড়িয়ে ফরহাদ মজহারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়। তারা ফরহাদের কলাম ও বই দিয়ে প্রভাবিত হয়। বিশেষ করে ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা আসার পর ফরহাদ নয়াদিগন্ত পত্রিকা কেন্দ্রিক অ্যাক্টিভিজম শুরু করলে এই ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে।
শিবিরের লোকদের মধ্যে বলা যায় মুজাহিদ ও আবদুর রাজ্জাকের গ্রুপিং লবিংয়ের অনেকটা বাইরেই ছিলেন মজিবুর রহমান মঞ্জু ও সেলিম উদ্দীন। এরমধ্যে মঞ্জু মীর কাসেম আলী কেন্দ্রিক হলেও আবদুর রাজ্জাক কেন্দ্রিক লোকদের তৎপরতায় তাকে তেমন দেখা যায়নি। আর সেলিম উদ্দিন গ্রুপিংয়ে না জড়াতে সংগঠনে মনোযোগী হন। এজন্য তিনি দিগন্তের ডিরেক্টর পদ ছেড়ে রমনা থানা জামায়াতের দায়িত্বে আসেন।
পরবর্তীতে বড় ঘটনা ঘটে, ২০১০ সালে মুজাহিদ গ্রুপের লোকেরা আবদুর রাজ্জাক গ্রুপের শিশির মনিরকে ছাত্র শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি হতে না দিয়ে উল্টা সেক্রেটারি জেনারেল পদ থেকে বিদায় দিলে দুই গ্রুপের বিবাদ প্রকাশ্যে চলে আসে।
আমার পর্যবেক্ষণ হলো, এই সময়টাতেই আবদুর রাজ্জাক গ্রুপ ও মীর কাসিম আলী ঘনিষ্ঠরা একীভূত হয়।
বিশেষ করে সাবেক শিবির সভাপতি ও জামায়াতের নির্বাহী পরিষদের কে বা কারা শিবিরের গণ্ডগোলে কোন পক্ষ নিচ্ছে এমন প্রশ্ন আসলে দেখা যায় মুজাহিদ গ্রুপ একপক্ষে ও আবদুর রাজ্জাক ও মীর কাসেম গ্রুপ একপক্ষে চলে আসে।
এর মধ্যে বলা হয় শহীদ আবদুল কাদের মোল্লা, শহীদ মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, শহীদ মীর কাসেম আলী, আনম আবদুজ্জাহের, সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহম্মদ তাহের, মজিবুর রহমান মঞ্জু, মুহম্মদ জাহিদুর রহমানরা একপক্ষে ছিলেন।
অন্যদিকে রফিকুল ইসলাম খান, নুরুল ইসলাম বুলবুল, হামিদুর রহমান আযাদ, শফিকুল ইসলাম মাসুদরা ছিলেন এক পক্ষে।
শিশির মনির, পরবর্তীতে আবদুল্লাহ আল মামুন সহ শিবির নেতাদের বড় অংশ সংগঠন ছাড়া হয়। তাদের নিজেদের মধ্যে একটা নেটওয়ার্ক সক্রিয় থাকে। যার আওতায় জামায়াত ভেঙে একটা নতুন দল করার চিন্তা দানা বাধে।
এরমধ্যে ২০১২-১৩ সাল পর্যন্ত ফরহাদ মজহারের সঙ্গে মঞ্জুদের দহরম মহরম বাড়তে থাকে।
২০১৪ সালে আমার কাছে তথ্য আসে যে, জামায়াত ভেঙে নতুন দল গঠনের বিষয়ে ফরহাদ মজহার গং সক্রিয়। এরমধ্যে মোসতাঈন জহিররা গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারপন্থী সাবেক শিবির নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত দেখা সাক্ষাৎ করে।
আর এ তথ্যসূত্রে জানতে পারি, জামায়াতের সংস্কারপন্থীরা ফরহাদ মজহারকে যুক্তরাজ্য ও মালয়েশিয়ায় সফর করিয়েছে এবং সেখানকার প্রবাসী জামায়াতের বৈঠকে তিনি বক্তৃতা করেছেন।
এখানে বলা দরকার, ফরহাদ মজহার বাংলাদেশের প্রথম ব্যক্তি যে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে নব্বই দশকে বই লিখেছিল। অনেকেই হয়তো জানে না যে, মাওলানা সাঈদীসহ জামায়াত নেতাদের ফাঁসির রায় লিখে দিয়েছিল বেলজিয়ামের যেই জিয়াউদ্দিন, সেও মূলতঃ ফরহাদ মজহারের একজন ঘনিষ্ঠ লোক।
এমনিতে ইনার সার্কেলে আমরা যখন বসতাম তখন ফরহাদ মজহার, গৌতম দাসরা জামায়াতের প্রতি নিজেদের বিদ্বেষ আড়াল করত না।
এই যে বিএনপি যেন জামায়াত নেতাদের ফাঁসি হলে কোনো বিবৃতি না দেয়, এমনকি সালাউদ্দিন কাদের চৌধিরীর বিষয়েও দূরত্ব রাখে, এর কুমন্ত্রণাদাতাও ছিল ফরহাদ মজহার। বিএনপিতে জামায়াত বিদ্বেষী অংশটাকে মতাদর্শিকভাবে উস্কানি প্রদানও ছিল তার অন্যতম অপকীর্তি।
পরবর্তীতে একটা ঘটনা ঘটে। এর শুরু অবশ্য হয়েছিল ২০১১ সালে খালেদা জিয়ার ভারত সফরের মধ্য দিয়ে। বিএনপি ভারতমুখী হয়ে পড়ে। দলটির সঙ্গে সরাসরি র`র একটা যোগাযোগ তৈরি হয়েছিল। যার প্রভাবে ভারত বিরোধিতার জন্য আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ও ফরহাদ মজহারের সঙ্গে বিএনপির দূরত্ব তৈরি হয়। বিএনপি ধারার সকল তৎপরতা থেকে এ দুজনকে বাদ রাখা হয়।
আর ঠিক এ সময়টাতে সামনে চলে আসেন ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরী। আগেই উল্লেখ করেছি জাফর ও নুরুল ইসলাম ভূঁইয়া ছোটন হলো ভায়রা।
জাফরুল্লাহর সক্রিয়তার সময়টাতে দেখা যায়, ফরহাদ মজহারের পারিষদ ও জামায়াতের সংস্কারপন্থীদের প্রায় সবাইকে ছোটন মেইনটেন করছে।
এরমধ্যে গৌতম দাস, মোসতাঈন জহির ও মোহাম্মদ রোমেলরা ছিল। ছোটনের দিক থেকে যোগ হয়েছিল পিনাকী ভট্টাচার্য ও আবু মুস্তাফিজ হাসান শাপলুরা।
এদের তত্ত্বাবধানে যখন মঞ্জুদের গ্রুমিং হলো তখন তারা ইসলামী রাজনীতি সংস্কারের অবস্থান থেকে সরে গেল। বলা যায় মঞ্জুরা এক্স ইসলামপন্থী হয়ে গেল এবং আদর্শ হিসাবে কার্যত সেক্যুলারিজমকে গ্রহণ করল। এক্ষেতের জনআকাঙ্খার সংবাদ সম্মেলনের কপিটি মুসতাঈন জহির লিখে দিয়েছিল। তা একটা সেক্যুলার বয়ান ছাড়া কিছুই নয়। মঞ্জুকে দেখা যায় মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রের তথাকথিত সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারকে নিজেদের আদর্শ বলতে চায়, এগুলান মূলত সেক্যুলার অঙ্গীকারই মাত্র।
মোট কথা হলো, যেহেতু ইসলাম প্রশ্নে ছোটন ছুপা বিদ্বেষী, সেহেতু ইসলামপন্থী রাজনীতির সংস্কারের স্লোগান তোলা মঞ্জুদেরকে ইসলামপন্থী রাজনীতি পরিত্যাগ করেই ছোটনের মন পেতে হয়। এক্ষেত্রে ছোটনদের মন পেতে মঞ্জুদেরকে গানবাজনা ও বেপর্দা নারীর উপস্থিতিও নিশ্চিত করতে হয়।
শেষ পর্ব
গার্ডিয়ানকে দিয়ে জামায়াতকে দূষণ: ছোটন: পিনাকী:মেসবাহ: নূরা
জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমীর মকবুল আহমেদসহ বড় বড় নেতারা মেসবাহ সাঈদের বাসায় আত্মগোপনে ছিল। মেসবাহর পরিবার আওয়ামী লীগ। তার এক ভাই সৌদি আওয়ামী নেতা। ফেনী থেকে নির্বাচন করতে চায়।
এই মেসবাহর বাসা ধানমন্ডির যেই ভবনে সেখানেই এক ফ্ল্যাটে থাকে নুরুল ইসলাম ভূইঁয়া ছোটন।
এ খবরটি জানার পর আমি নড়েচড়ে বসলাম। ডিজিএফআই কানেক্টেড ছোটন যে ভবনে থাকে, সেখানেই মেসবাহর বাসা! আবার সেখানে জামায়াত নেতারা পলাতক থাকেন!
এসব কিছু কি আসলে ম্যাটার করে?
আমি এ প্রশ্নের জবাব আমলে নিতে বাধ্য হয়েছি। কারণ শিবিরের ও জামায়াতের বড় বড় সূত্রগুলো সাঈদকে ঘিরে কীর্তি কারখানার একটা এমন কিছু তথ্য দিয়েছে তাতে করে কিছুই উপেক্ষা করা যায় না।
একসূত্রের দাবি, সাঈদরা ফাইভ স্টার হোটেলে মদ্যপান করে। নারী ঘটিত অভিযোগও আছে। তারপরেও সাঈদকে প্রাইজ পোস্ট হিসাবে জামায়াতের ঢাকা মহানগরীর শুরা সদস্য করা হয়েছে। আদৌতে সে জামায়াতের নামকাওয়াস্তে রুকন। এর বাইরে কোনো দায়িত্বে না থাকলেও শুরা সদস্য। তাকে ফেনীতে উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীও করা হয়েছে।
মজার ব্যাপার হলো সাঈদ এবি পার্টি গঠন প্রক্রিয়ায় ছিল। মজিবুর রহমান মঞ্জুর সঙ্গে সে গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিল।
এর প্রমাণ হলো, এবি পার্টি গঠনে অন্যতম অর্থ যোগানদাতা বায়োফার্মার এমডি লকিয়তুল্লাহ, মজিবুর রহমান মঞ্জুদের ব্যবসায়িক উদ্যোগ নভ হেলথ সার্ভিসে মেসবাহ সাঈদও পার্টনার ছিল৷ এই প্রতিষ্ঠানটি গড়া হয়েছিল এবি পার্টিকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্যই। তবে পরবর্তীতে জামায়াতের কাছ থেকে বেশি ফায়দা পাওয়ার প্রলোভন পেয়ে মেসবাহ যুবলীগের ঢাকা মহানগরের কিছু নেতার মাধ্যমে লকিয়তুল্লাহদের প্রতিষ্ঠান ও টাকা পয়সা মেরে দেয়।
এখন কথা হলো সাঈদের সঙ্গে এবি পার্টি ও ছোটনের সম্পর্ক কিভাবে ফাংশন করেছিল?
শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি, কার্যকরী পরিষদ সদস্য ও জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের সন্তানরা আলাপকালে আমাকে এর বিস্তারিত জানিয়েছেন।
মূলতঃ এবি পার্টি গঠনের আগে মজিবুর রহমান মঞ্জুদের পক্ষে শিবিরের কেন্দ্রীয় আইটি বিভাগের সহকারী দায়িত্বশীলরা প্রচারণা চালিয়েছিল। এতে গার্ডিয়ান প্রকাশনীর নূর মোহাম্মদদের পুরো গ্যাং জড়িত ছিল। এরা ফিজিক্যালিও শিবিরের অনেক লোকককে সংস্কারপন্থা সমর্থন করতে বলেছে।
আর নূর মোহাম্মদদের এই পুরো গ্যাংটার সম্পর্ক হলো মেসবাহ সাঈদের সঙ্গে।
মজার ব্যাপার হলো ছোটন ইসলামপন্থীদের কাছে যা চায় তাই সাঈদ-নূর৷ মোহাম্মদদরা ফেসবুক প্রচার করে।
এর বড় তিনটা প্রমাণ আছে। যার প্রথমটা হলো পিনাকী ভট্টাচার্য কানেকশন।।
পিনাকী কানেকশন
নুরুল ইসলাম ভূইয়া ছোটনদের এক চাওয়া ছিল ইসলামপন্থী তরুণরা যেন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে ইসলামের জায়গা থেকেই সমর্থন করে। এমনটি করা গেলে একাত্তর প্রশ্নে জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগের ঐতিহাসিক অবস্থানের পক্ষে জনজোয়ার বন্ধ হয়ে যাবে। বিশেষ করে জামায়াত নেতাদের ফাঁসি, সারা দেশে ম্যাসাকার, শাপলা চত্বরে ম্যাসাকারের ঘটনায় ইসলামপন্থীরাতো বটে, সাধারণ মুসলমানরা মুক্তিযুদ্ধকে যেভাবে ঘৃণা করছিল তা বানচাল করে দিয়ে একাত্তর নামক বিষই যেন ইসলামপন্থীরা পান করে তা ছিল ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র`, এর অনুগত ডিজিএফআই ও ছোটন দালালদের মাস্টার প্ল্যান।
এই কাজটি বাস্তবায়ন করা হয়েছিল পিনাকী ভট্টাচার্যকে দিয়ে। তিনিই ঘৃন্য মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বই লেখেন "মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে ইসলাম"। এই বইটির প্রকাশক হলো গার্ডিয়ান প্রকাশনী। মানে ২০১৩ সালের আন্দোলনসহ জামায়াত নেতাদের ফাঁসির ঘটনায় বাঁশেরকেল্লাসহ অনলাইন স্ফিয়ারে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতার দায়িত্ব পালন করছিল শিবিরের যে আইটি বিভাগ, তারাই ২০১৭ সালে এসে দায়িত্ব নিল মুক্তিযুদ্ধকে ইসলামী মোড়কে প্রচার করার। বাংলাদেশের ইসলামী রাজনীতির ইতিহাসে এটিই হলো সর্বোচ্চ গাদ্দারী।
ছোটন-পিনাকীদের এই মুক্তিযুদ্ধ প্রজেক্ট মেসবাহ সাঈদ, নূর মোহাম্মদ, কমরেড মাহমুদ গ্যাংয়ের মাধ্যমে শিবিরের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
এরপরের কাহিনী হলো, খোদ জামায়াতের মধ্যেই কথা শুরু হয় যে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধিতা থেকে জামায়াতকে বের হতে হবে।
এবং যেই শহীদ নেতাদের জন্য ২০১৪ সাল থেকে জামায়াত শিবিরের সর্বস্তরে প্রশ্নাতীত সমীহশ্রদ্ধা জারি হয়েছিল, সেই নেতারা একাত্তরে ভুল করেছিল নতুন করে বলাবলি শুরু হলো।
এক্ষেত্রে ছোটন লিঙ্কের সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের কতটা কটাক্ষ করে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে কথা বলেছেন তা ডয়েচেভেলেতে দেখা গেছে। গার্ডিয়ান প্রকাশনী গ্যাংয়ের লোকেরাতো নিয়মিতই একাত্তরের পজিশনকে কটাক্ষ করেই।
ছোটনদের আরেক চাওয়া হলো বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের যেন জোট না থাকে। এক্ষেত্রে দেখবেন মেসবাহ সাঈদ-নূর মোহাম্মদদের গ্যাং নিয়মিতই অতি জামায়াত প্রেম দেখিয়ে বিএনপি বিদ্বেষী প্রচারণা চালায়। এতে বিএনপির লোকদের সঙ্গে অনলাইনে মনোমালিন্য তৈরি হয়েছে, তেমনি জামায়াতের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বিএনপির সঙ্গে জোটের বদলে লীগের সঙ্গে আঁতাত শ্রেয় মনোভাব তৈরি হয়েছে।
তৃতীয় প্রমাণ হলো ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা র`র মদদপুষ্ট চরমোনাই পার্টিকে ইসলামপন্থী তরুণ প্রজন্মকে গ্রহণযোগ্য করাতে ছোটনদের মিশনের পক্ষ মেসবাহ সাঈদ-নূর মোহাম্মদ-কমরেড মাহমুদ গ্যাংয়ের প্রচারণা।
চরমোনাইয়ের লোকেরা জামায়াতের ফাঁসি হওয়া নেতাদের শহীদ মনে করে না৷ তারপরেও চরমোনাইয়ের পক্ষে জামায়াতের একাংশ ফেসবুকে প্রচারণা চালায়, এটি মূলতঃ ছোটনের ইচ্ছারই প্রতিফলন। তার অ্যাসাইনমেন্ট হিসাবেই নূরারা চরমোনাইয়ের গান গায়।
আমি ছোটনকে নিয়ে লেখা শুরুর পর ঢাকার একজন সাংবাদিক আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। ভিন দেশ থেকে আমি যখন ছোটনকে ঘিরে নানা সমীকরণ মিলাচ্ছি তখন তিনি বলেছিলেন ডিজিএফআইয়ের একটা মিশন হলো জামায়াত ও চরমোনাইকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং এদেরকে দিয়ে বিএনপির প্রতিপক্ষ একটা জোট দাড় করানো, আর এটি করার দায়িত্ব হলো ছোটনের।
মজার ব্যাপার হলো, পরবর্তীতে বরিশাল সিটি নির্বাচন ঘিরে মেসবাহ-নূরা-মাহমুদ গ্যাং চরমোনাইয়ের এক পোলার পক্ষে প্রচারণা চালায়। তারপর সে আওয়ামী লীগের হাতে মার খেলে চরমোনাই ও জামায়াত ঐক্য নিয়ে এরা প্রোপাগান্ডা শুরু করে।
পরবর্তীতে দেখা যায়, চরমোনাইকে সান্ত্বনা দিতে জামায়াত নেতারা ছুটে যায়, জামায়াত আমীর ফোনে কথা বলেন৷ আর চরমোনাইয়ের এক সভায় প্রথমবারের মতো জামায়াত দাওয়াত প্রাপ্ত হয়। এই পুরো ঘটনাপ্রবাহের নেপথ্যে ছোটন।
বাংলাদেশের রাজনীতির নেপথ্যের মানুষদের নিয়ে অনেক বিস্তারিত কাজ করার আছে। আমি চাইলে ছোটনের তৎপরতার সঙ্গে প্রথম আলোর সংযোগ ও এনজিও কর্মী লেলিনরা জড়িত তা নিয়েও লিখতে পারি। কিন্তু একটা ধারণা দিতেই ছোটনকে বেশ লম্বা আলোচনা করেছি। এখন আগ্রহীরা বিস্তারিত খুঁজতে পারেন। সময় সুযোগ হলে হয়তো নানা লোকদের তৎপরতা নিয়ে বলব। আমার কাজটা সহজ, লোকজনের চিন্তা, তৎপরতা ও নেটওয়ার্কগুলো শনাক্ত করা। ছোটনদের চারপাশে যারা ঘুরপাক খাচ্ছেন তারা আশা করি নেটওয়ার্ক সম্পর্কে ভালোমতো সচেতন হবেন।