প্রকাশিত: : ডিসেম্বর ১, ২০২৫, ০৩:৪৭ পিএম
মানুষের স্মৃতি, ভাষা ও দৈনন্দিন কাজ সম্পাদনের ক্ষমতা একসঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাকে বলা হয় ডিমেনশিয়া। আলঝেইমারস, পারকিনসনস–জনিত ডিমেনশিয়া, স্ট্রোকজনিত ডিমেনশিয়া ও লুই বডি ডিমেনশিয়াসহ রয়েছে একাধিক ধরন। সম্পূর্ণ নিরাময় এখনো নেই, তবে দ্রুত শনাক্তকরণ ও উপসর্গ নিয়ন্ত্রণে চিকিৎসা ও সচেতনতা গুরুত্বপূর্ণ।
মানবজীবনে মনে রাখার কতগুলো বিভাগ আছে। যেমন স্মরণশক্তি, ভাষা, কার্য সম্পাদন করার ক্ষমতা, চোখে দেখা ও তা প্রয়োগ করার ক্ষমতা এবং সবশেষে ব্যবহারিক দক্ষতা। ডিমেনশিয়া আমরা তখনই বলি, যখন কমপক্ষে দুটি বিভাগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উদাহরণস্বরূপ কারো স্মরণশক্তি এবং ভাষা প্রয়োগ করার ক্ষমতা দুটিই লোপ পেল, তখন আমরা সেই ব্যক্তিকে ডিমেনশিয়া রোগে ভুগছে বলে অভিহিত করি
ডিমেনশিয়ার প্রকারভেদ
ডিমেনশিয়ার অনেক প্রকারভেদ রয়েছে। যেমন—
আলঝেইমারস ডিমেনশিয়া
সারা পৃথিবীতে প্রায় ৫৫ মিলিয়নের অধিক লোক আলঝেইমারস ডিমেনশিয়ায় ভুগছে। বয়স যত বাড়তে থাকে, আলঝেইমারস ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি তত বেশি বাড়তে থাকে। দেখা গেছে, ৬৫ বছরের পর থেকে প্রতি পাঁচ বছরে আলঝেইমারস রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়ে যায়। জেনেটিক প্রভাবের কারণে আলঝেইমারস রোগ হয়। সেক্ষেত্রে রোগটা শুরু হয় ৬০ বছর বয়সের আগে। বেশি বয়সে ডিপ্রেশন, একাকিত্ব ও শারীরিক পরিশ্রমের অভাবে আলঝেইমারস রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
আলঝেইমারস রোগে স্মরণশক্তি বেশ লোপ পায়। যেমন সকালে কী নাশতা করেছেন বা গত ছুটির দিনে কোথায় বেড়াতে গেছেন এগুলো মনে থাকে না। কিন্তু দূরের স্মৃতি মনে থাকে। ভাষাগত দিক থেকে যেমন মানুষের নাম, জিনিসের নাম মনে থাকে না। রোগটা বাড়তে থাকে, নিজে নিজে হিসাবনিকাশ করা কঠিন হয়ে পড়ে। ব্যবহারিক সমস্যাও দেখা দেয়। যেমন মাঝে মাঝে উত্তেজিত হয়ে যায়, ঘুম কম হয় এবং কান্নাকাটি করে।
পারকিনসনস রোগের ডিমেনশিয়া
পারকিনসনস রোগের ডিমেনশিয়ায় কার্যক্ষমতা এবং চোখে দেখে তা ডিজাইন করার ক্ষমতা লোপ পায়। দেখা গেছে, শতকরা ৩০ ভাগ পারকিনসনস রোগী পরবর্তী জীবনে ডিমেনশিয়া রোগে ভোগে।
মানুষ নিজে একাকী তার প্রয়োজনীয় কার্যাবলি সম্পাদন করার ক্ষমতা রাখে। পারকিনসনস রোগ ছাড়াও ঘন ঘন ব্রেইন স্ট্রোকের ফলে এ ক্ষমতা লোপ পায়। এ ক্ষমতা দেখার জন্য আমরা কিছু পরীক্ষা করে থাকি, যেমন ৩০ থেকে ক্রমান্বয়ে ৩ বাদ দিলে কত হয় অথবা কতগুলো সংখ্যাকে সামনের দিক থেকে অথবা পেছনের দিক থেকে গুনতে বলা হয়। এছাড়া এখানে ব্রেইনের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা দেখা হয়, যেমন বলা হলো কুকুর ও বিড়ালের মধ্যে কি মিল। যার বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা থাকে না তার উত্তর হবে উভয়ের চারটি করে পা আছে। আসল উত্তর দুটোই প্রাণী।
লুই বডি ডিমেনশিয়ায় চোখে দেখে তা ডিজাইন করার ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি লোপ পায়। যেমন একজন রোগীকে একটা কিউব আঁকা আছে তা দেখে আঁকতে বলা হলো, সেটা সে সঠিকভাবে পারবে না। ডিমেনসিয়া রোগে প্রতিদিনের কার্যাবলিও বাধাগ্রস্ত হয়। প্রথম দিকে জটিল কাজগুলো করতে অসুবিধা হবে। তারপর রোগ যত বাড়তে থাকবে, দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় কাজকর্মে অন্যের সাহায্য লাগবে। যেমন খাওয়াদাওয়া, ড্রেসিং, টয়লেটিং ইত্যাদি।
ডিমেনশিয়া প্রতিরোধ
ডিমেনশিয়া প্রক্রিয়াকে বন্ধ করার জন্য এখনো তেমন ওষুধ আবিষ্কার হয়নি, তবে ডিমেনশিয়া রোগে ভোগার সময়ে যে সমস্যাগুলো দেখা দেয়, তা নিরাময়ের জন্য ওষুধ বাজারে পাওয়া যায়। বিভিন্ন ডিমেনশিয়া রোগে ব্রেইনের মধ্যে অ্যাসিটাইল কোলিন নামে এক ধরনের নিউরোট্রান্সমিটার কমে যায়।
দেখা গেছে, অ্যাসিটাইলকোলিনের পরিমাণ ব্রেইনে বাড়িয়ে দিতে পারলে ডিমেনশিয়া রোগের উপসর্গগুলো কমে যায়। এখন বাজারে ব্রেইনে অ্যাসিটাইলকোলিন বাড়ানোর অনেক ওষুধ পাওয়া যাচ্ছে। এ ওষুধ ব্যবহার করলে ডিমেনসিয়া রোগের উপসর্গগুলো অনেক লাঘব হয়।
চিকিৎসাবিজ্ঞান উন্নত হচ্ছে, মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। সেই সঙ্গে ডিমেনশিয়া রোগের প্রকোপও বাড়ছে দিন দিন। সারা পৃথিবীতে ডিমেনশিয়া বিশেষ করে আলঝেইমারস ডিমেনশিয়ার প্রক্রিয়াকে স্থগিত করার জন্য বিস্তর গবেষণা চলছে। আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা এ সমস্যা সমাধানে সম্পূর্ণ সফল হবেন।
লেখক: মেডিসিন ও নিউরোলজি বিশেষজ্ঞ
সিনিয়র কনসালট্যান্ট, নিউরোলজি বিভাগ
ল্যাবএইড স্পেশালাইজড হাসপাতাল