প্রকাশিত: : নভেম্বর ১৩, ২০২৫, ০১:২৬ পিএম
যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর এইচ-১বি নীতি এবং বৈশ্বিক প্রযুক্তি প্রতিযোগিতার সুযোগে চীন চালু করেছে নতুন কে-ভিসা, যার লক্ষ্য দক্ষ বিদেশি প্রযুক্তিকর্মী আকর্ষণ। তবে উচ্চ বেকারত্ব, ভাষা-সংকট ও কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা এই উদ্যোগের সফলতার বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রে কাজের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন দক্ষ ভারতীয় আইটি পেশাজীবী বৈষ্ণবী শ্রীনিবাসগোপালন এখন চীনে চাকরির খোঁজে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি খাতের কর্মীদের লক্ষ্য করে বেইজিং চালু করেছে নতুন কে-ভিসা কর্মসূচি, যা তার এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পারে।
গত মাসে চালু হওয়া এই কে-ভিসা কর্মসূচি বৈশ্বিক মেধা ও অত্যাধুনিক প্রযুক্তির প্রতিযোগিতায় যুক্তরাষ্ট্রকে ধরার চীনের বৃহত্তর প্রচেষ্টার অংশ। এটি এমন এক সময়ে এসেছে, যখন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কঠোর অভিবাসন নীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের এইচ-১বি কর্মসূচি অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে।
কয়েক বছর আগে তার বাবা একটি চীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করতেন। সেই সূত্রে চীনের কর্মপরিবেশ ও সংস্কৃতির প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন শ্রীনিবাসগোপালন। তিনি বলেন, `চীনের কে-ভিসা যুক্তরাষ্ট্রের এইচ-১বি ভিসার মতোই। আমার মতো মানুষের জন্য বিদেশে কাজের এটি একটি ভালো বিকল্প।`
কে-ভিসা চীনের বিদ্যমান ভিসা কাঠামোকে আরও সম্প্রসারিত করেছে, যার মধ্যে বিদেশি পেশাদারদের জন্য থাকা আর-ভিসাও অন্তর্ভুক্ত। এতে আবেদনের আগে চাকরি নিশ্চিত করার মতো শর্ত শিথিল করা হয়েছে।
ট্রাম্পের আমলে বিদেশি শিক্ষার্থী ও গবেষকদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর নীতি—যার মধ্যে নতুন আবেদনকারীদের জন্য এইচ-১বি ভিসার ফি ১,০০,০০০ ডলারে বাড়ানোর সিদ্ধান্তও রয়েছে—অনেক অ-আমেরিকান পেশাজীবী ও শিক্ষার্থীকে অন্য দেশে সুযোগ খোঁজার কথা ভাবতে বাধ্য করছে।
চীনের সিচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভারতীয় ছাত্র বিকাশ কালী দাস বলেন, `যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীরা (এইচ-১বি) ভিসার আশা করেছিল, কিন্তু এখন সেটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।`
চীন আরও বিদেশি প্রযুক্তি কর্মী চায়
এই সুযোগকে কাজে লাগাতে চীন দ্রুত পদক্ষেপ নিচ্ছে। ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি উন্নত প্রযুক্তিতে বৈশ্বিক নেতৃত্ব অর্জনকে অগ্রাধিকার দিয়েছে এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সেমিকন্ডাক্টর ও রোবোটিক্সের মতো খাতে গবেষণা ও উন্নয়নে বিপুল সরকারি সহায়তা দিচ্ছে।
নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা ড্রাগনফ্লাইয়ের এশিয়া অঞ্চলের প্রধান ও সহযোগী পরিচালক বারবারা কেলেমন বলেন, `বেইজিং যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর অভিবাসন নীতিকে বিশ্বব্যাপী বিদেশি মেধা ও বিনিয়োগ আকর্ষণের একটি সুযোগ হিসেবে দেখছে।`
চীনা স্নাতকদের মধ্যে বেকারত্ব এখনো বেশি, এবং বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তি খাতে চাকরির প্রতিযোগিতা তীব্র। তবে দক্ষ জনবলের ঘাটতি রয়েছে, যা পূরণে আগ্রহী চীনের নেতৃত্ব। কয়েক দশক ধরে চীন উন্নত দেশগুলোর কাছে মেধা হারাচ্ছে—অনেকে পড়াশোনা শেষে যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপে থেকে গিয়ে কাজ করছেন।
তবে এই `ব্রেইন ড্রেন` পুরোপুরি উল্টো ঘুরে দাঁড়ায়নি। ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের সহযোগী অধ্যাপক আলফ্রেড উ বলেন, অনেক চীনা অভিভাবক এখনো পশ্চিমা শিক্ষাকে শ্রেষ্ঠ মনে করেন এবং সন্তানদের বিদেশে পাঠাতে আগ্রহী।
তবুও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনা-আমেরিকানসহ ক্রমবর্ধমান সংখ্যক পেশাজীবী—যেমন এআই বিশেষজ্ঞ, বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে চীনে ফিরছেন। ইন্টেলের চিপ আর্কিটেক্ট ফেই সু এবং মার্কিন সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠান আলটেয়ারের শীর্ষ প্রকৌশলী মিং ঝোউ এই বছর চীনে শিক্ষকতা শুরু করেছেন।
কনসালটেন্সি ফার্ম নিউল্যান্ড চেজের সাংহাই-ভিত্তিক অভিবাসন পরিচালক এডওয়ার্ড হু জানান, ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দক্ষ কর্মী ইতোমধ্যেই কে-ভিসার প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছেন।
বিদেশি কর্মীদের প্রতিযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন
চীনে শিক্ষার্থী বাদে ১৬ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার প্রায় ১৮ শতাংশ হওয়ায় বিদেশি পেশাজীবী আকৃষ্টের এই পদক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
পূর্ব চীনের ঝেজিয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ের আচরণ বিজ্ঞানের ছাত্রী ঝোউ জিনইয়িং বলেন, `বর্তমান চাকরির বাজার ইতোমধ্যেই অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক।`
তার মতে, বিদেশি পেশাজীবীরা `নতুন প্রযুক্তি ও আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি` নিয়ে আসতে পারেন, তবে এতে কিছু তরুণ চীনা চাকরিপ্রার্থী `কে-ভিসা নীতির কারণে অতিরিক্ত চাপ অনুভব করতে পারে।`
দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর গুয়াংজুর ২৬ বছর বয়সী সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার কাইল হুয়াং বলেন, তার সহকর্মীদের আশঙ্কা—নতুন ভিসা কর্মসূচি `স্থানীয় চাকরির সুযোগকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।`
রাষ্ট্র-সমর্থিত সংবাদমাধ্যম `সাংহাই অবজারভার`-এর সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এসব আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে বলা হয়েছে, বিদেশি পেশাজীবীদের আগমন চীনের অর্থনীতির জন্য লাভজনক হবে। সেখানে বলা হয়েছে, চীন যখন এআই ও উন্নত সেমিকন্ডাক্টরের মতো খাতে এগোচ্ছে, তখন যোগ্য প্রার্থী ও দক্ষ কর্মীর চাহিদার মধ্যে একটি `ব্যবধান ও অসামঞ্জস্য` তৈরি হয়েছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, `বিশ্ব যত জটিল হবে, চীন তত বেশি তার দুয়ার খুলে দেবে।`
কনসালটেন্সি ফার্ম জিওপলিটিক্যাল স্ট্র্যাটেজির প্রধান কৌশলবিদ মাইকেল ফেলার বলেন, `বেইজিংকে দেখাতে হবে কীভাবে নির্বাচিত বিদেশি মেধা স্থানীয় চাকরি তৈরি করতে পারে, ছিনিয়ে নিতে নয়।` তিনি আরও যোগ করেন, `তবে এমনকি ওয়াশিংটনও দেখিয়েছে—দশকের পর দশক প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও এটি রাজনৈতিকভাবে কঠিন যুক্তি।`
নতুন ভিসা সত্ত্বেও চীনের চ্যালেঞ্জ
নিয়োগ ও অভিবাসন বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদেশি কর্মীরা চীনে নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েন—সবচেয়ে বড় সমস্যা ভাষা এবং সরকারের ইন্টারনেট সেন্সরশিপ, যা `গ্রেট ফায়ারওয়াল` নামে পরিচিত।
১.৪ বিলিয়ন মানুষের দেশে ২০২৩ সাল পর্যন্ত মাত্র প্রায় ৭ লাখ ১১ হাজার বিদেশি কর্মী বসবাস করছিলেন।
কনসালটেন্সি ডেজান শিরা অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটসের সিঙ্গাপুর কান্ট্রি ডিরেক্টর ডেভিড স্টেপাট বলেন, `যুক্তরাষ্ট্র এখনো গবেষণায় এগিয়ে এবং ইংরেজির ব্যাপক ব্যবহার সেখানে একটি বড় সুবিধা। পাশাপাশি, সেখানে বসবাসেরও তুলনামূলকভাবে স্পষ্ট ও সহজ পথ রয়েছে।`
যুক্তরাষ্ট্রে গ্র্যাজুয়েট স্কুল শেষে একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ভারতীয় এইচ-১বি ভিসাধারক নিখিল স্বামীনাথন বলেন, তিনি চীনের কে-ভিসায় আগ্রহী হলেও কিছুটা দ্বিধায় আছেন। `আমি এটা বিবেচনা করতাম,` তিনি বলেন, `প্রযুক্তি খাতে কাজের জন্য চীন দারুণ জায়গা—যদি ভারত ও চীনের সম্পর্ক এতটা জটিল না হতো।`
তবে অনেক চাকরিপ্রার্থী সুযোগ পেলেও এখনো চীনের বাইরের শীর্ষ বৈশ্বিক কোম্পানিগুলোকেই অগ্রাধিকার দেবেন।
ফেলার বলেন, `যুক্তরাষ্ট্র হয়তো তার এইচ-১বি আবেদনকারীদের কিছুটা হারাবে যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো অন্যান্য পশ্চিমা অর্থনীতির কাছে, তবে চীনের কাছে নয়।`
তিনি বলেন, `যুক্তরাষ্ট্র হয়তো নিজেকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে, কিন্তু মেধা আকর্ষণের ক্ষেত্রে এটি এখনো অনেক বেশি প্রতিযোগিতামূলক অবস্থানে রয়েছে। সেরাদের আকর্ষণ করতে হলে চীনের শুধু সুবিধাজনক ভিসা পথ নয়, আরও অনেক কিছু করতে হবে।`