প্রকাশিত: : এপ্রিল ১৪, ২০২৫, ০৫:২৯ পিএম
চলতি ২০২৫ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি ২৬.৬৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। চীনের ওপর নির্ভরতা কমাতে মার্কিন ক্রেতারা ক্রমেই বাংলাদেশের দিকে ঝোঁকায় এ প্রবৃদ্ধি ঘটেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তবে ট্রাম্প প্রশাসনের পুনরায় আরোপিত পাল্টা শুল্কের ফলে বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা ও বাজার স্থিতিশীলতা নিয়ে তৈরি হয়েছে নতুন অনিশ্চয়তা।
সরকারি বাণিজ্য পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে ১.৫ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করেছে, যা আগের বছরের একই সময়ের ১.১৮ বিলিয়ন ডলারের তুলনায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৃদ্ধি। এই প্রবৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশ এখন চীন ও ভিয়েতনামের পর যুক্তরাষ্ট্রে তৃতীয় বৃহত্তম পোশাক সরবরাহকারী হিসেবে অবস্থান পেয়েছে।
আলোচ্য সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানিতে চীন ও ভিয়েতনামের প্রবৃদ্ধি যথাক্রমে ৮.৮৫ শতাংশ ও ১১.১৪ শতাংশ। অর্থাৎ, রপ্তানিতে বাংলাদেশ সবচেয়ে বড় প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। প্রতিযোগিতামূলক মূল্য, শ্রম ও পরিবেশ সংক্রান্ত নিয়মনীতি মেনে চলা এবং চীন থেকে অর্ডার সরে আসাই এই প্রবৃদ্ধির মূল কারণ।
এরপরেও সতর্ক অবস্থায় আছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। মার্কিন পণ্যের ওপর বেশি শুল্ক আরোপকারী দেশগুলোকে জবাব দেওয়ার লক্ষ্যে ট্রাম্প প্রশাসন সম্প্রতি `পাল্টা শুল্ক` আরোপের যে উদ্যোগ নিয়েছে, তাতে বিশ্ব বাণিজ্য নীতিতে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
যদিও বাংলাদেশ এখনো সরাসরি এই নীতির আওতায় আসেনি, তবুও খাতসংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, `ফেয়ার ট্রেড` বা ন্যায্য বাণিজ্যের নামে যেকোনো নীতিগত পরিবর্তন বা চাপ ভবিষ্যতে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার হ্রাস কিংবা নতুন ধরণের জটিলতা তৈরি করতে পারে।
"এই প্রবৃদ্ধি আশাব্যঞ্জক, তবে বৈশ্বিক বাণিজ্য পরিবেশ দিন দিন অস্থির হয়ে উঠছে," বলেন তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি আবদুল্লাহ হিল রাকিব।
তিনি আরও বলেন, "ওয়াশিংটনের শুল্ক রাজনীতির কারণে যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, তাতে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ পরিকল্পনা বা অর্ডারের ধারাবাহিকতা নির্ধারণ করা কঠিন হয়ে পড়ছে।"
২০২৫ সালের প্রথম দুই মাসে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে মোট ১৩.৫৫ বিলিয়ন ডলারের তৈরি পোশাক আমদানি করেছে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১১.২০ শতাংশ বেশি।
ভারত ও পাকিস্তানও উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে—দেশ দুটির রপ্তানি যথাক্রমে ২৫.৭০ শতাংশ ও ২৩.০৫ শতাংশ বেড়েছে। অন্যদিকে, হন্ডুরাসের মতো কিছু দেশ ২০.৮৬ শতাংশ রপ্তানি হ্রাসের মুখে পড়েছে, যা বৈশ্বিক উৎস ব্যবস্থা বা সোর্সিং ম্যাপে দ্রুত পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
বাণিজ্য বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি আরও সুরক্ষামূলক (প্রোটেকশনিস্ট) বাণিজ্যনীতি গ্রহণ করে, তাহলে জিএসপি (জেনারালাইজড সিস্টেম অফ প্রিফারেন্সেস)–এর মতো বাণিজ্য সুবিধাগুলোর ওপর বাড়তি নজরদারি আসতে পারে। যদিও বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত বর্তমানে ভিন্ন এক রপ্তানি ব্যবস্থার আওতায় পরিচালিত হচ্ছে।
বাংলাদেশ এখন সুযোগ কাজে লাগাতে পারলেও, সামনের পথ অনিশ্চয়তায় ভরা। খাতসংশ্লিষ্টদের মতে, দীর্ঘমেয়াদি প্রবৃদ্ধি নির্ভর করবে যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তনশীল বাণিজ্যনীতি কোন পথে এগোয় এবং বাংলাদেশ কতটা সফলভাবে নিজেকে একটি স্থিতিশীল ও উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন সরবরাহকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত রাখতে পারে তার ওপর।
গত ২ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশসহ বেশ কয়েকটি দেশের রপ্তানির ওপর ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করে। পরে যদিও ওয়াশিংটন এই সিদ্ধান্ত ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করেছে এবং আপাতত কেবল প্রচলিত ১০ শতাংশ শুল্কই বহাল রয়েছে।
"এই স্থগিতাদেশ আমাদের জন্য একটি কৌশলগত সুযোগ তৈরি করেছে," বলেন বাংলাদেশ পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মাশরুর রিয়াজ।
তিনি বলেন, "তবে ৯০ দিন পর কী হবে, তা এখনও অনিশ্চিত। তাই আমাদের এখনই ভাবতে হবে—আমরা বিনিময়ে কী প্রস্তাব দিতে পারি; একইসঙ্গে কূটনীতি, বাণিজ্য আলোচনা ও বাজারভিত্তিক কৌশলসহ একাধিক পর্যায়ে আমাদের কাজ করতে হবে।"
তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান, যুক্তরাষ্ট্রের তুলা রপ্তানিকারকদের জন্য বন্ডেড গুদাম সুবিধার মতো পারস্পরিক ছাড় দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নিতে। একই সঙ্গে, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়িয়ে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে ভারসাম্য আনারও পরামর্শ দেন তিনি।
মাশরুর রিয়াজ আরও বলেন, "আমাদের বহুমুখী কৌশল নিতে হবে—যার মধ্যে কূটনৈতিক আলোচনার সূচনা, বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে আমদানি বৃদ্ধি এবং বাজারভিত্তিক সমাধানে ক্রেতাদের সঙ্গে নিয়মিত সংলাপ অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।"