প্রকাশিত: : ডিসেম্বর ৬, ২০২৫, ০৯:৩৯ পিএম
১০০ কোটি ডলার বা এর বেশি সম্পদের মালিকদের বলা হয় বিলিয়নেয়ার। এ বিলিয়নেয়ারদের মধ্যে অনেকেই বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জন করেছেন সফল উদ্যোক্তা হিসেবে। আবার উত্তরাধিকার সূত্রে নিকটজনের কাছ থেকে পাওয়া সম্পদের জোরেও বিলিয়নেয়ার হয়েছেন অনেকে। বিশ্বব্যাপী বিলিয়নেয়ারদের সম্পদের গতিপ্রকৃতি নিয়ে ২০১৫ সাল থেকে গবেষণা করে আসছে সুইস ব্যাংক ইউবিএস। ব্যাংকটির সর্বশেষ প্রকাশিত ‘ইউবিএস বিলিয়নেয়ার অ্যাম্বিশনস রিপোর্ট ২০২৫’ অনুসারে, বিশ্বজুড়ে বিলিয়নেয়ারের সংখ্যা এখন ২ হাজার ৯১৯।
আগের বছরের প্রতিবেদনে এ সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৬৮২। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে বিশ্বব্যাপী বিলিয়নেয়ারের সংখ্যা বেড়েছে ৮ দশমিক ৮ শতাংশ। একই সময় তাদের সম্মিলিত সম্পদের পরিমাণ ১৩ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ডলারে।
সংস্থাটির হিসাবে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত সফল উদ্যোক্তা হিসেবে স্ব-অর্জিত সম্পদে নতুন করে বিলিয়নেয়ারের তালিকায় যুক্ত হয়েছেন ১৯৬ ধনকুবের, যাদের সম্মিলিত সম্পদের আকার ৩৮ হাজার ৬৫০ কোটি ডলার।
এছাড়া উত্তরাধিকার সূত্রে নতুন বিলিয়নেয়ারের সংখ্যা বাড়ার গতিও এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। গত এপ্রিল পর্যন্ত এক বছরে বিশ্বব্যাপী উত্তরাধিকার সূত্রে নতুন বিলিয়নেয়ার হয়েছেন ৯১ জন, যা এ হিসাব শুরুর পর থেকে রেকর্ড সর্বোচ্চ। এ সময়ের মধ্যে নতুন এ বিলিয়নেয়ারদের হাতে এসেছে ২৯ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। উত্তরাধিকার সূত্রে নতুন বিলিয়নেয়ারের হাতে সম্পদ হস্তান্তরের পরিমাণের দিক থেকেও এটি নতুন রেকর্ড। উত্তরাধিকার সূত্রে নতুন বিলিয়নেয়ারদের মধ্যে ৬৪ জন পুরুষ ও ২৭ জন নারী।
ইউবিএসের নির্বাহী বেঞ্জামিন ক্যাভাল্লি বলেন, ‘এ প্রবণতা প্রমাণ করছে, বিশ্বব্যাপী ধনী পরিবারগুলোর সম্পদ হস্তান্তরের ঢেউ আরো তীব্র হচ্ছে। আগামী ১৫ বছরে অন্তত ৫ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন ডলার উত্তরাধিকার সূত্রে হাতবদল হতে পারে।’
২০৪০ সাল নাগাদ সবচেয়ে বেশি উত্তরাধিকার সম্পত্তি হস্তান্তর হবে যুক্তরাষ্ট্রে। এরপর থাকবে ভারত, ফ্রান্স, জার্মানি ও সুইজারল্যান্ড। তবে উচ্চ জীবনমান, নিরাপত্তা, ভূরাজনৈতিক ও করনীতির কারণে বিশ্বজুড়ে ধনীদের মাঝে অভিবাসনের চাহিদা বাড়ছে। এতে বদলে যেতে পারে সম্পদ স্থানান্তরের প্রাক্কলনে পাওয়া তথ্যও।
ইউরোপের বিভিন্ন দেশে চলতি বছর অতিধনীদের ওপর সম্পদ কর আরোপের দাবি জোরালো হয়েছে। সুইজারল্যান্ডে গত মাসে ৫ কোটি সুইস ফ্রাঁর বেশি উত্তরাধিকার ও সম্পদ হস্তান্তরের ওপর ৫০ শতাংশ করসংক্রান্ত প্রস্তাব গণভোটে নাকচ হয়েছে। ফ্রান্সেও ১০ কোটি ইউরোর বেশি সম্পদের ওপর ২ শতাংশ কর আরোপের প্রস্তাব দেশটির পার্লামেন্টের অনুমোদন পায়নি।
বিদেশে আয়ের ওপর বহুল আলোচিত ফ্ল্যাট ট্যাক্সের হার ২০২৬ সাল থেকে ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে বছরে ৩ লাখ ইউরো করার পরিকল্পনা করছে ইতালি। যুক্তরাজ্য নন-ডম স্ট্যাটাস তুলে দেয়ায় বিদেশে আয়ের ওপর কর এড়ানোর সুযোগ বন্ধ হয়েছে। একই সঙ্গে ২০ লাখ পাউন্ডের বেশি দামের বাড়ির ওপর অতিরিক্ত কর আরোপের ঘোষণা এসেছে বাজেটে।
গত বছর জি২০-এর বৈঠকে অতিধনীদের ওপর বৈশ্বিক ন্যূনতম ২ শতাংশ কর আরোপের দাবি জানায় স্পেন, ব্রাজিল, জার্মানি ও দক্ষিণ আফ্রিকা। ফরাসি অর্থনীতিবিদ গ্যাব্রিয়েল জুকম্যানের হিসাব অনুযায়ী, এ কর বছরে ২৫ কোটি ডলার পর্যন্ত রাজস্বের উৎস হতে পারে।
ইউবিএসের পরিসংখ্যান অনুসারে, বিশ্বে নতুন বিলিয়নেয়ার সৃষ্টির প্রবণতায় এগিয়ে রয়েছে এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল। এ অঞ্চল চলতি বছর ১২৮ নতুন বিলিয়নেয়ার পেয়েছে। ইউবিএস সিঙ্গাপুরের প্রধান ইয়াং জিন ই জানান, চীনসহ পুরো অঞ্চলের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার সম্পদ বৃদ্ধিকে গতিশীল করেছে।
অঞ্চলভেদে দেখা যায়, এশিয়া-প্যাসিফিক ১ হাজার ৩৬ বিলিয়নেয়ারের আবাসস্থল। এরপর সমগ্র আমেরিকায় (উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা মিলিয়ে) ১ হাজার ৫২ জন এবং ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা অঞ্চলে রয়েছে ৫৪৭ জন বিলিয়নেয়ার। সংযুক্ত আমেরিকা মহাদেশে বিলিয়নেয়াররা সম্মিলিতভাবে ৭ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার সম্পদের মালিক। এক বছরে তাদের সম্পদ বেড়েছে ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ। এশিয়া-প্যাসিফিক এবং ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা অঞ্চলে এ অতিধনিক শ্রেণীর সম্পদ বেড়েছে যথাক্রমে ১১ দশমিক ১ ও ১০ দশমিক ৪ শতাংশ।
স্ব-অর্জিত বিলিয়নেয়ারের সংখ্যা বৃদ্ধিতে এগিয়ে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আমেরিকা অঞ্চলের দেশগুলোয় এ ধরনের ধনাঢ্যের সংখ্যা ৯২, যাদের মধ্যে ৮৭ জনের বসবাস যুক্তরাষ্ট্রে। এশিয়া-প্যাসিফিকে নতুন উদ্যোক্তা ধনকুবেরের সংখ্যা ৬১ এবং ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় ৪৩।
এ অতিধনীদের নতুন সম্পদ সৃষ্টিতে বৈশ্বিক পুঁজিবাজারে প্রযুক্তি খাতনির্ভর নতুন আইপিওগুলোকে বড় ধরনের অনুঘটক হিসেবে দেখছেন ইউবিএসের বিশ্লেষক হার্টমুট ইসেল। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, চীন ও হংকংয়ের শক্তিশালী পুঁজিবাজার এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করছেন ব্যাংকটির আরেক কর্মকর্তা কনরাড হুবার।
সম্পদ বৃদ্ধির হারের দিক থেকে নারী বিলিয়নেয়াররা পুরুষদের ছাড়িয়ে গেছেন বলে ইউবিএসের তালিকায় উঠে এসেছে। ব্যাংকটির হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বজুড়ে নারী বিলিয়নেয়ারের সংখ্যা এখন ৩৭৪। এক বছরে তাদের গড় সম্পদ ৮ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়ে ৫২০ কোটি ডলারে পৌঁছেছে। পুরুষ বিলিয়নেয়ারদের ক্ষেত্রে এ বৃদ্ধির হার ৩ দশমিক ২ শতাংশ। নারী বিলিয়নেয়ারদের সম্পদ বৃদ্ধিতে ভোক্তা ও খুচরা বাজার খাত প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে। ইউবিএস সিঙ্গাপুরের প্রধান ইয়াং জিন ই জানান, নারী উদ্যোক্তা বিলিয়নেয়ারের অনুপাত সবচেয়ে বেশি এশিয়া-প্যাসিফিকে।
দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে বিলিয়নেয়ারদের আগ্রহের জায়গায় এখন বড় ধরনের পরিবর্তন আসছে বলে অভিমত বিশ্লেষকদের। অতিধনীদের মধ্যে ৩৪ শতাংশ এখন বৃহত্তর চীনকে সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনাময় বিনিয়োগ ক্ষেত্র হিসেবে দেখছেন। গত বছর এ হার ছিল মাত্র ১১ শতাংশ। একই সময় চীন বাদে এশিয়া-প্যাসিফিকে অন্যান্য দেশকে বিনিয়োগের জন্য আকর্ষণীয় মনে করছেন ৩৩ শতাংশ বিলিয়নেয়ার। বিশ্বজুড়ে অতিধনীদের মধ্যে এখন হেজ ফান্ড, উন্নত শেয়ারবাজার ও স্বর্ণসহ মূল্যবান ধাতুতে বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। তাদের উদ্বেগের প্রধান জায়গাগুলো হলো শুল্কবৃদ্ধি, বড় ধরনের ভূরাজনৈতিক সংঘাত ও দেশে দেশে নীতিগত অনিশ্চয়তা।