শনিবার, ০৬ ডিসেম্বর, ২০২৫

ভারতে নতুন বাবরি মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন আজ

টিএনসি ডেস্ক

প্রকাশিত: : ডিসেম্বর ৬, ২০২৫, ০১:৩১ পিএম

অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ৩৩তম বার্ষিকীতে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদে নতুন বাবরি মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছেন বহিষ্কৃত তৃণমূল নেতা হুমায়ূন কবীর; সম্ভাব্য উত্তেজনা এড়াতে প্রশাসনে কড়া সতর্কতা।

ভারতে নতুন বাবরি মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন আজ

অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ৩৩তম বার্ষিকীর দিনেই পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলায় নতুন বাবরি মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছেন সম্প্রতি তৃণমূল কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত বিধায়ক হুমায়ূন কবীর।

শনিবার স্থানীয় সময় দুপুর ১২টায় রেজিনগর এলাকায় এ কাজ শুরুর কথা রয়েছে বলে জানিয়েছে হিন্দুস্তান টাইমস।

অঞ্চলজুড়ে এই অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে সম্ভাব্য উত্তেজনার আশঙ্কায় প্রশাসন উচ্চ সতর্কতায় রয়েছে। কলকাতা হাইকোর্ট পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে পরিষ্কার নির্দেশ দিয়েছে- শান্তি বজায় রাখতে যা যা প্রয়োজন, তার সব ব্যবস্থা নিতে হবে।

আদালত বলেছে, সাম্প্রদায়িক উদ্দীপনা যাতে কোনোভাবেই ছড়িয়ে না পড়ে, তা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব।

সরকারের পক্ষ থেকে আদালতকে জানানো হয়েছে, মুর্শিদাবাদে এরই মধ্যে কঠোর নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়েছে। অ্যাডভোকেট জেনারেল কিশোর দত্ত জানান, অশান্তি রোধে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

ডেপুটি সলিসিটর জেনারেল রাজদীপ মজুমদার জানান, এলাকায় সিআইএসএফের ১৯টি কোম্পানি রয়েছে; পাশাপাশি র‌্যাফ ও রাজ্য পুলিশের যৌথভাবে মোতায়েন করা হয়েছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার সদস্য।

জাতীয় সড়ক–১২ এর নিরাপত্তায় প্রস্তুত রাখা হয়েছে বিএসএফের দুই ইউনিটও।

হুমায়ূন কবীর জানিয়েছেন, উদ্বোধনী আয়োজনে কেবল কোরআন তিলাওয়াত হবে প্রায় দুই ঘণ্টা। সেখানে থাকবে না কোনো দলীয় পতাকা, রাজনৈতিক বক্তৃতা বা মঞ্চ। তার ভাষায়, “অনুষ্ঠানটি ধর্মীয়ই থাকবে; আমি থাকব প্রায় দুই হাজার স্বেচ্ছাসেবকসহ।”

মুর্শিদাবাদের ভরতপুর থেকে নির্বাচিত এই নেতা বাবরি মসজিদ নির্মাণের ঘোষণা দেওয়ার পর তৃণমূল কংগ্রেস তাকে দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে বহিষ্কার করেছে।

এ সিদ্ধান্তের পর কবীর ঘোষণা দিয়েছেন, আগামী ২২ ডিসেম্বর তিনি একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করবেন। তবে এর বিস্তারিত এখনও জানাননি তিনি।

বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনা ভারতীয় উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে এক গভীর ও বাঁকবদলের মুহূর্ত। ১৫২৮ সালে মুঘল সম্রাট বাবরের সেনাপতি মীর বাকী অযোধ্যায় এই মসজিদ নির্মাণ করেন বলে প্রচলিত ইতিহাসে পাওয়া যায়।

দীর্ঘ সময় এটি ভারতীয় মুসলমানদের ধর্মীয় উপাসনালয় হিসেবে টিকে ছিল। কিন্তু ১৯ শতকের শেষভাগ থেকেই হিন্দু ধর্মীয় সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে দাবি উঠতে থাকে যে মসজিদটির স্থানে আসলে ছিল রাম জন্মভূমি- অর্থাৎ হিন্দুদের মতে ভগবান রামের জন্মস্থান। এই দাবি থেকেই শুরু হয় আইনি লড়াই, মালিকানা বিরোধ এবং ক্রমশ তা রাজনীতির কেন্দ্রে উঠে আসে।

১৯৮০–এর দশকে হিন্দুত্ববাদী আন্দোলন যখন দেশে নতুন করে সংগঠিত হতে শুরু করে, তখন বাবরি মসজিদ–রাম জন্মভূমি ইস্যুটি বিজেপি (ভারতীয় জনতা পার্টি) এবং আরএসএস (রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ)-এর রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কৌশলের মূল ইন্ধন হয়ে ওঠে।

১৯৮৪ সালে বিজেপি সংসদে মাত্র কয়েকটি আসনের দল হলেও রাম মন্দির আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তারা জনপ্রিয়তা অর্জন করতে থাকে। আরএসএস ও তার সহযোগী সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি) বৃহৎ জনসমর্থন গঠনে সক্রিয় ভূমিকা নেয়; মিছিল, শোভাযাত্রা, প্রচার–একই সঙ্গে ধর্মীয় অনুভূতি ও রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদকে উষ্কে দেওয়া হয়।

এই ধারাবাহিক প্রক্রিয়ারই বিস্ফোরণ ঘটে ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর।

সেদিন অযোধ্যায় লাখো করসেবক (হিন্দুত্ববাদী কর্মী ও সমর্থক) জমায়েত হয়, যার নেতৃত্বে ছিল ভিএইচপি, আরএসএস ও বিজেপির একাংশ। কেন্দ্রীয় প্রতিশ্রুতি ও আদালতের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও ‘করসেবা’ নামের রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত এই জমায়েতই ধীরে ধীরে উত্তেজনা ও উন্মাদনায় রূপ নেয়।

দুপুরের পরপরই ধর্মীয় স্লোগানের মাঝে একদল সংগঠিত কর্মী মসজিদের দেয়ালে ওঠে হাতুড়ি, দা, লোহার রডসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম দিয়ে গঠন ভাঙতে শুরু করে। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ৪৬০ বছর পুরোনো সেই স্থাপনাটি গুঁড়িয়ে মাটির সঙ্গে মিশে যায়।

স্থানীয় প্রশাসন, রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের নিষ্ক্রিয়তা- এমনকি ইচ্ছাকৃত নীরবতা; ঘটনাটিকে আরও প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। পরে বিভিন্ন তদন্ত ও আদালতের পর্যবেক্ষণে বিজেপি ও আরএসএস নেতাদের উপস্থিতি, ভূমিকা এবং করসেবকদের সংগঠিতভাবে মসজিদ ধ্বংসের পরিকল্পিত দিক নিয়ে বহুবার আলোচনা ও বিতর্ক ওঠে।

এই ধ্বংস ভারতেই নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঢেউ তোলে। কয়েক হাজার মানুষ দাঙ্গা–সংঘর্ষে প্রাণ হারান। বাবরি মসজিদ ভাঙা শুধু ইট–পাথরের একটি স্থাপনা ধ্বংস নয়; এটি ছিল ধর্মীয় পরিচয়ের রাজনীতিকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রের নীতি, বিচারব্যবস্থা এবং বহুত্ববাদী ভারতের সামাজিক কাঠামোর ওপর সরাসরি আঘাত।

এরপর থেকে রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদ ইস্যু ভারতের রাজনৈতিক সময়রেখায় কেন্দ্রীয় স্থান দখল করে আছে এবং হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উত্থানে এটি অন্যতম বড় মাইলফলক।

Link copied!