প্রকাশিত: : ডিসেম্বর ১, ২০২৫, ০৫:১৩ পিএম
তুরস্কের ইস্তাম্বুলে মানুষ আর পথবিড়াল মিলেই গড়ে উঠেছে এক অনন্য সহাবস্থানের সংস্কৃতি। রাস্তা, পার্ক, মসজিদ থেকে ক্যাফে—শহরের প্রতিটি কোণায় তাদের অবাধ বিচরণ; যত্ন, খাবার আর ভালোবাসায় তারা যেন শহরেরই স্বীকৃত নাগরিক।
রাস্তার প্রতিটি বাঁকে, দোকানের জানালায়, দরজার চৌকাঠ মাড়িয়ে ভেতরে, এমনকি গাড়ির ছাদে—সবখানেই তাদের নিত্য আনাগোনা। কখনও বা তারা কোনো মাংসের দোকানের সামনে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে ধৈর্য ধরে বসে থাকে, সুস্বাদু এক টুকরোর আশায়।
শহরের মানুষগুলোও যেন তাদের `সেবাদাতা`র ভূমিকায় নামতে অভ্যস্ত; বেশিরভাগ সময়েই দেখা যায়, কেউ না কেউ উদারভাবে তাদের জন্য কিছু একটা রেখে যাচ্ছেন। আবার প্রায়শই তারাই চুপচাপ হেঁটে যায় তাদের `মালিক` নয় এমন কারও যত্নে রাখা খাবারের বাটির দিকে।
এই সাম্রাজ্যের নিয়ম ভাঙার ফলও কিন্তু ভুগতে হবে! আপনি কোনো রেস্টুরেন্টে খেতে বসলেন, তবে তাদের পেটের দাবি মেটাননি। মুহূর্তেই হয়তো কানে ভেসে আসবে এক `মিউ` গর্জন! তাকিয়ে দেখবেন, পাশের উঁচু জায়গায় বসে থাকা তারা আপনার প্লেট থেকে তাদের প্রাপ্য খাবারের ভাগ চেয়ে নিচ্ছে।
ফুটপাত থেকে শুরু করে ব্যস্ত রাস্তার মাঝখান, প্রাচীন মসজিদ, মেট্রো স্টেশন, আধুনিক ক্যাফে কিংবা ছাদের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া বা পার্কে আলস্যে গা এলিয়ে দেওয়া—সবখানেই তাদের অবাধ গতি। বাজারে তারা টুকটাক নাস্তা খাচ্ছে, আবার কখনো বা দোকানের ভেতর দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে—কোনো বাধা নেই।
তুরস্কে ঘুরতে আসলে ইস্তাম্বুলের সংস্কৃতিতে বিড়ালের বিশেষ স্থান টের পেতে বেশি সময় লাগার কথা না। তবে মহানগরে পা রাখার আগে আপনি যত প্রস্তুতিই নিন না কেন, এই শহরের অলিতে-গলিতে বিড়ালের এমন প্রাচুর্যের জন্য প্রস্তুত থাকা সম্ভবত অসম্ভব।
এমনকি বসফরাসের জলপথের ওপর দিয়ে যাওয়া ফেরিতেও তাদের নির্বিঘ্নে পারাপার হতে দেখা যায়। ইউরোপ আর এশিয়া—দুই তীরে অবস্থিত দুটি পার্ককে তারা নিজেদের পছন্দের আড্ডাস্থল বানিয়ে নিয়েছে। ক্যাফের চেয়ার বা টেবিলে বসে বিশ্রাম নিতেও তারা বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না—কারণ, এই শহর যে তাদেরও!
তাদের বয়স, রং, গড়ন বা আকার ভিন্ন হতে পারে। কেউ হয়তো একাকী ঘুরে বেড়ানো `সোলজার`, আবার কেউ দলবেঁধে চলা `গ্যাংস্টার`। তবে তারা যেই হোক না কেন, অটোমান সাম্রাজ্যের দিনগুলো থেকে শুরু করে আধুনিক ইস্তাম্বুলের অলিতে-গলিতে এই বিড়ালেরা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে নিজেদের মতো করে শাসন করছে।
কার্পেটের দোকানের মতো শহরের প্রতিটি কোণায় কোণায় বিড়ালও যেন শত শত বছরের পুরোনো এই শহরটির ইতিহাস ও সংস্কৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে মিশে আছে; বাসিন্দারা এই প্রাণীগুলোর সঙ্গে শহরের সবটা ভাগ করে নিয়েছে। বিড়ালপ্রেমীদের কাছে ইস্তাম্বুলের একটি জনপ্রিয় ডাকনামও প্রচলিত; `ক্যাটস্তাম্বুল`। এই বিশেষ আকর্ষণে সারা বিশ্বজুড়ে অনেক পর্যটক কেবল এই বিড়ালদের দেখতেই ইস্তাম্বুল ভ্রমণে আসেন।
দেড় কোটিরও বেশি মানুষের এই মহানগরীতে প্রতিনিয়ত যে `ঠাঁই` পাওয়ার প্রতিযোগিতা, তার মধ্যে এই বিড়ালরা অনেকটা - একটি পোষা বিড়াল যেমন আরাম করে সোফার অর্ধেকটা আর কফি টেবিলের অন্য অর্ধেকটা জুড়ে বসে থাকে, ঠিক তেমনই। কারণ, ধারণা করা হয়, এই শহরে প্রায় আড়াই লাখ পথচারী বিড়ালেরও বসবাস।
`সিটি ক্যাটস অব ইস্তাম্বুল` বইয়ের ফটোগ্রাফার ও লেখক মার্সেল হেইজেন এই সম্পর্কের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, ইস্তাম্বুলের বিড়ালগুলো পুরোপুরি পোষাও নয়, আবার পুরোপুরি ভবঘুরেও নয়। এলাকার মানুষজন দলবদ্ধভাবে তাদের যত্ন নেন। বিড়ালদের প্রতি এমন গভীর শ্রদ্ধা ও যত্নশীলতা তিনি পৃথিবীর আর কোথাও দেখেননি।
বিড়ালদের প্রতি এই ভালোবাসার প্রাতিষ্ঠানিক রূপও আছে। `ক্যাট মিউজিয়াম ইস্তাম্বুল`-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা ফাতিহ দাউলি জানান, `প্রত্যেক পৌরসভার অধীনে একটি ভেটেরিনারি বিভাগ আছে। তারা পথবিড়ালদের জন্য বিনামূল্যে নিউটারিং সেবাও দিয়ে থাকে।` তিনি আরও জানান, বেসরকারি পশু চিকিৎসাকেন্দ্রগুলোও পথবিড়ালদের জন্য কম মূল্যে সেবা দেয়। বাসিন্দারাও প্রায়শই ভেটেরিনারি বিল মেটানোর জন্য নিজেদের পক্ষ থেকে আর্থিক সাহায্য করেন।
বিড়ালের প্রতি এই গভীর অনুরাগ কিন্তু নতুন নয়। হেইজেন জানান, `পথবিড়ালের প্রতি এই ভালোবাসা সেই অটোমান সাম্রাজ্যের দিনগুলো থেকে শুরু। সেই সময়ে স্থানীয় দাতব্য সংস্থাগুলো নিশ্চিত করত যেন পথপ্রাণীদের ঠিকমতো যত্ন নেওয়া হয়।`
শুধু তাই নয়, পথবিড়ালদের প্রতি এই ভালোবাসা থেকে `মানজাজি` নামে একটি একসময় পূর্ণকালীন পেশাও তৈরি হয়। মানজাজিদের প্রধান দায়িত্ব ছিল শহরের বিড়ালদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা। স্থানীয় বাসিন্দারাও মানজাজিদের কাছ থেকে খাবার কিনে বিড়ালদের খাওয়াতেন।
এই সম্পর্কের শেকড় আরও গভীরে খুঁজে বের করেন ফাতিহ দাউলি। তিনি বলেন, ` ফিনিশীয় যুগ থেকেই সমুদ্রগামী ব্যবসায়ীরা ইঁদুর থেকে নিজেদের রক্ষা করতে জাহাজে বিড়াল রাখতেন।` রোমান এবং অটোমান আমলে ব্যস্ত ইস্তাম্বুলের বন্দরগুলোতে রেশম ও মশলার বাণিজ্য জাহাজ ভেড়ার সঙ্গে সঙ্গেই অসংখ্য বিড়ালও এসে ভিড় করত বলে জানান তিনি।
আপনি যদি ঐতিহাসিক ফাতিহ এলাকা হেঁটে দেখেন এবং বিখ্যাত ব্লু মসজিদ ও হাজিয়া সোফিয়া মসজিদ ঘুরতে যান, তবে আপনার সঙ্গে সুলো নামের একটি বিড়ালের দেখা হতে পারে। এই গোলগাল ধূসর-সাদা ডোরাকাটা বিড়ালটিকে সুলতানাহমেত স্কোয়ারে প্রায়শই পর্যটকদের জন্য পোজ দিতে দেখা যায়। যে খবরের কাগজ বিক্রেতা তার যত্ন নেন, সুলো কখনও তার কাছ থেকে দূরে থাকে না।
পাহাড়ি এলাকায় এবং বসফরাসের তীর ঘেঁষে বিড়ালদের প্রায়ই বেঞ্চ ও সিঁড়িতে শুয়ে থাকতে দেখা যায়। আবার কাঠের তৈরি `এ-ফ্রেম` বিড়াল ঘরগুলোতে তারা নিশ্চিন্তে দুপুরের ঘুম সেরে নেয়। বাজারের বাইরে এবং মেট্রো স্টেশনগুলোর পাশে শুকনো খাবার ও পানির বাটি অপেক্ষায় থাকে ক্ষুধার্ত বিড়ালদের জন্য। স্থানীয় বাসিন্দা ও পর্যটকরা ক্যাফেতে নিজেদের খাবারের কিছু অংশ সানন্দে ভাগ করে নেন সেই পথবিড়ালদের সঙ্গে, যারা আলতো করে তাদের পায়ে গা ঘষে যায়।
এই কোলাহলপূর্ণ, ব্যস্ত মহানগরীতে ইস্তাম্বুলের পথবিড়ালগুলো যেন সবচেয়ে শান্ত নাগরিক। যে কোনও শহরকে সাধারণত তার কোমলতার জন্য খুব কমই স্বীকৃতি দেওয়া হয়। শহর তৈরি হয় মানুষের জন্য—রাস্তা, অট্টালিকা, সেতু এবং ইট, কংক্রিট, কাঁচ ও স্টিলের মতো কঠিন উপাদান দিয়ে। যেখানে পথপ্রাণীদের জীবন ততটা সহজ নয়, সেখানে ইস্তাম্বুলের বিড়ালরা যেন একরকম স্বাচ্ছন্দ্যেই আছে।
হেইজেন বলেন, `এই ইট, কংক্রিটের ভিড়ে মানুষ বাদে অন্য একটি প্রাণীর নিজস্ব জায়গা করে নেওয়াটা সত্যিই বিশেষ কিছু। আর তাদের প্রতি স্থানীয়দের যত্নশীল হওয়াটা আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ।`