প্রকাশিত: : অক্টোবর ১৪, ২০২৫, ০৫:২৪ পিএম
বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতন নিয়ে বিবিএস ও ইউএনএফপিএ–এর এক জরিপে দেখা গেছে, দেশের অর্ধেকেরও বেশি নারী জানেন না কোথায় অভিযোগ জানাতে হয়। প্রতি চারজনের মধ্যে তিনজন জীবনে কোনো না কোনো সময়ে সঙ্গীর সহিংসতার শিকার হয়েছেন। তবু সামাজিক লজ্জা ও ভয়েই অধিকাংশ নারী নীরব থাকছেন।
সহিংসতা বা নির্যাতনের শিকার হলে কোথায় অভিযোগ জানাতে হবে, তা জানেন না দেশের অর্ধেকের বেশি নারী। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) এক জরিপে এই উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে।
জরিপে অংশ নেওয়া নারীদের মধ্যে মাত্র ৪৮.৫ শতাংশ জানেন কোথায় বা কীভাবে অভিযোগ জানাতে হবে। আর যারা জানেন তাদের মধ্যে বেশিরভাগই পুলিশের কথা উল্লেখ করেছেন।
গতকাল সোমবার রাজধানীর বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে এই জরিপের ফল প্রকাশ করা হয়। দেশব্যাপী ১৫ বছর বা তার বেশি বয়সী ২৭,৪৭৬ জন নারীর সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে জরিপ চালানো হয়েছে। এর আগে ২০১১ ও ২০১৫ সালেও অনুরূপ জরিপ চালানো হয়েছিল। এই জরিপে গত এক দশকে নারী নির্যাতনের প্রবণতা এবং এর ভয়াবহতার চিত্র উঠে এসেছে। এতে দেখা যায়, বস্তি, দুর্যোগপ্রবণ এলাকা এবং প্রতিবন্ধী নারীসহ সমাজের সব স্তরের নারীরাই সহিংসতার শিকার হচ্ছেন।
জরিপে অংশ নেওয়া নারীদের মধ্যে বিশেষায়িত সেবা সম্পর্কে সচেতনতা উদ্বেগজনকভাবে কম। মাত্র ২.২ শতাংশ নারী `ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার` সম্পর্কে শুনেছেন। বছরের পর বছর ধরে প্রচারণা সত্ত্বেও শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার নারীদের মধ্যে মাত্র ৯.৩ শতাংশ সরকারের জাতীয় হেল্পলাইন ১০৯ সম্পর্কে জানেন, যা সহিংসতা থেকে মুক্ত নারীদের (১৫.৭ শতাংশ) চেয়েও কম।
আশঙ্কার বিষয় হলো, তালাকপ্রাপ্ত এবং বিধবা নারীদের মধ্যে মাত্র ৩.৩ শতাংশ হেল্পলাইন সম্পর্কে জানেন। নির্যাতনের শিকার অনেকেই বলেছেন, বহু বছর পর তারা জেনেছেন কোথায় সহায়তা পাওয়া যায়।
সচেতনতার এই অভাবের পাশাপাশি দেশে নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রাও অত্যন্ত ব্যাপক। প্রতি চারজন নারীর মধ্যে তিনজন (৭৬ শতাংশ) জীবনে কোনো না কোনো সময়ে তাদের সঙ্গীর দ্বারা সহিংসতার শিকার হয়েছেন। গত এক বছরেই নারীদের প্রায় অর্ধেক (৪৯ শতাংশ) এমন সহিংসতার শিকার হয়েছেন।
তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে ব্ল্যাকমেইলের শিকার হওয়ার ঘটনাও ঘটছে অহরহ। জরিপে অংশ নেওয়া নারীদের ৮ দশমিক ৩ শতাংশ নারী প্রযুক্তি-নির্ভর সহিংসতার শিকার হয়েছেন।
অন্যদিকে, নিপীড়নের কথা গোপন রাখেন বেশিরভাগ নারী। প্রতি তিনজন নারীর মধ্যে দুজন (৬৪ শতাংশ) তাদের নির্যাতনের অভিজ্ঞতা কখনো কাউকে বলেন না। যারা বিষয়টি জানিয়েছেন, তাদের মধ্যে ৭৮.৮ শতাংশ বাবা-মাকে, ৩৫.২ শতাংশ শ্বশুরবাড়ির লোককে এবং ৩২.৮ শতাংশ ভাইবোনকে বলেছেন।
সহিংসতার শিকার হয়ে প্রতিকার চাওয়ার ক্ষেত্রে নারীরা প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার চেয়ে সামাজিক সমাধানকেই বেশি পছন্দ করেন। প্রতিকারপ্রার্থীদের মধ্যে ৫৮.৪ শতাংশ স্থানীয় নেতাদের কাছে গিয়েছেন। মাত্র ৩৬.২ শতাংশ পুলিশের কাছে এবং ১৫ শতাংশ আদালতে গিয়েছেন।
অভিযোগ না করার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে—সহিংসতাকে স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে মেনে নেওয়া (৩৮.৮ শতাংশ), পারিবারিক সম্মান হারানোর ভয় এবং সামাজিক লজ্জার আশঙ্কা। এসব প্রতিবন্ধকতা নারীদের নীরব থাকতে বাধ্য করছে।
গত এক বছরে সহিংসতার শিকার নারীদের মধ্যে মাত্র ১৪.৫ শতাংশ চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে ৯৩ শতাংশ শারীরিক আঘাতের জন্য এবং ১৫.৫ শতাংশ মানসিক আঘাতের জন্য চিকিৎসা নেন।
নির্যাতনকারীদের অধিকাংশই স্বামী
জরিপে `সঙ্গী` বলতে বর্তমান বা প্রাক্তন স্বামীকে বোঝানো হয়েছে। দেখা গেছে, নারীদের ওপর সহিংসতায় প্রধান ভূমিকা থাকে স্বামীর।
নিপীড়নের ঘটনায় সচরাচর যা বেশি ঘটে তা হলো নারীদের চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করা। এর শিকার হয়েছেন ৬৮ শতাংশ নারী। এরপর রয়েছে শারীরিক নির্যাতন (৪৭ শতাংশ), মানসিক নির্যাতন (৩৭ শতাংশ) এবং যৌন নির্যাতন (২৯ শতাংশ)।
অন্য যেকোনো ব্যক্তির তুলনায় নারীরা স্বামীর দ্বারা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা তিনগুণ এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা ১৩ গুণেরও বেশি। শারীরিক নির্যাতন প্রায়শই পুনরাবৃত্তিমূলক। ২৯.৪ শতাংশ নারী ছয় বা তার বেশিবার শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। প্রায় ২৬ শতাংশ নারী স্বামীর দ্বারা জোরপূর্বক যৌন মিলনে বাধ্য হওয়ার কথা জানিয়েছেন, এবং তাদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি (৫৫.৯ শতাংশ) বলেছেন এই ধরনের ঘটনা বারবার ঘটেছে। এমনকি গর্ভাবস্থায়ও ৭ শতাংশ নারী শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
জরিপে দেখা যায়, ১৫-১৯ বছর বয়সী বিবাহিত কিশোরীরা সহিংসতার সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। গত এক বছরে সঙ্গীর দ্বারা নির্যাতনের শিকার নারীদের ৬২ শতাংশই এই বয়সী। গ্রামীণ অঞ্চলের তুলনায় সিটি করপোরেশন এলাকার নারীরা ৩৫ শতাংশ এবং বস্তিতে বসবাসকারী নারীরা ৪৭ শতাংশ বেশি সহিংসতার ঝুঁকিতে রয়েছেন।
অঞ্চলভেদেও সহিংসতার চিত্রে তারতম্য দেখা গেছে। শারীরিক নির্যাতনে খুলনা বিভাগ শীর্ষে (৫৭.২ শতাংশ) এবং সিলেট সর্বনিম্ন (৩৩.৫ শতাংশ)। যৌন নির্যাতনে বরিশাল শীর্ষে (৩৬ শতাংশ) এবং ময়মনসিংহ সর্বনিম্ন (২৩ শতাংশ)।
জরিপে সহিংসতার ঝুঁকির কারণগুলোও চিহ্নিত করা হয়েছে। স্বামীর বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক নির্যাতনের ঝুঁকি ২.৩ গুণ, মাদকাসক্তি ১.৭ গুণ এবং যৌতুকের কারণে বিয়ে ১.৮ গুণ বাড়ায়। অন্যদিকে, শিক্ষা একটি রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। যেসব নারীর স্বামীরা মাধ্যমিক পাস করেছেন, তাদের ক্ষেত্রে সহিংসতার ঝুঁকি ১৭ শতাংশ কম এবং বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া স্বামীর ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি ৩২ শতাংশ কম।
অর্থ উপার্জনকারী নারীরা সঙ্গীর দ্বারা ২৮ শতাংশ বেশি সহিংসতার শিকার হন, যা জেন্ডার ভূমিকার পরিবর্তনের বিরুদ্ধে এক ধরনের প্রতিক্রিয়া হতে পারে।
বিয়ের সম্পর্কের বাইরে শাশুড়ি (৩৫ শতাংশ), মা (২০.৫ শতাংশ), দেবর বা ননদ (২৯ শতাংশ) এবং পরিবারের অন্য পুরুষ সদস্যরা (৩৪ শতাংশ) শারীরিক নির্যাতনের প্রধান হোতা। সঙ্গী নন এমন ব্যক্তিদের দ্বারা যৌন সহিংসতার বেশিরভাগ ঘটনা ঘটে পুরুষ আত্মীয়, বন্ধু বা পরিচিতদের দ্বারা।