রবিবার, ২৭ এপ্রিল, ২০২৫

নব্বই ও চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান: সেনাবাহিনীর সমর্থন প্রত্যাহারে চূড়ান্ত পতন হয় স্বৈরশাসকের

টিএনসি ডেস্ক

প্রকাশিত: : এপ্রিল ২৬, ২০২৫, ০৩:৩৩ পিএম

নব্বই ও চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান: সেনাবাহিনীর সমর্থন প্রত্যাহারে চূড়ান্ত পতন হয় স্বৈরশাসকের

১৯৯০ সালের ১৯ নভেম্বর। এরশাদ সরকারের পদত্যাগের দাবিতে তিন জোট অভিন্ন রূপরেখা ঘোষণা করে। এদিকে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে দৃঢ় ছিলেন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। আন্দোলন ক্রমে গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। সেই সময় সেনাপ্রধানসহ পুরো সেনাবাহিনী আন্দোলনকারীদের পক্ষে অবস্থান নেয়। ফলে উপায়ান্তর না দেখে এরশাদকে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হতে হয়।

এর ৩৪ বছর পর, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে, শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনও গণ-অভ্যুত্থানের রূপ নেয়। শেখ হাসিনা সরকারের দীর্ঘ ১৬ বছরের শাসন নড়বড়ে হয়ে পড়ে। ১৬ জুলাই থেকে ৩ আগস্ট পর্যন্ত নানা কৌশলে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা করেন শেখ হাসিনা। বিক্ষোভ দমনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ব্যবহার করা হয়। শত শত মানুষকে হত্যা করেও সরকার আন্দোলন দমাতে পারেনি, বরং তা আরও তীব্র হয়। একপর্যায়ে সেনাবাহিনীকেও গুলি করার নির্দেশ দেওয়া হয়, তবে সেনাবাহিনী নিরস্ত্র জনতার ওপর গুলি চালাতে অস্বীকৃতি জানায়। শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা ছেড়ে দেশত্যাগ করতে হয়।

বিশ্লেষকদের মতে, স্বাধীনতা-পরবর্তী দুটি গণ-অভ্যুত্থানেই সেনাবাহিনীর ভূমিকা ছিল নির্ধারক। সেনাবাহিনী সাধারণ মানুষের পাশে না দাঁড়ালে প্রাণহানি ও বিশৃঙ্খলার ভয়াবহতা আরও বাড়ত।

২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয় জুনের প্রথম সপ্তাহে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে সংগঠিত হয়ে টিএসসিতে বিক্ষোভ করে। রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার পর আন্দোলন জোরদার হয়। ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর দেশব্যাপী বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্রলীগ-যুবলীগ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দমন-পীড়ন সত্ত্বেও আন্দোলন আরও প্রবল হয়। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের একদফা দাবিতে আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে।

৩ আগস্ট সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে ছাত্র-জনতার পক্ষে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। রয়টার্সের খবরে জানা যায়, সেনাসদস্যরা নিরস্ত্র বেসামরিক মানুষের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকৃতি জানান। শেখ হাসিনা দেশত্যাগের আগের রাতেও সেনাপ্রধানের নেতৃত্বে এই অবস্থান পুনর্ব্যক্ত হয়।

সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্যরাও সে সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ৪ আগস্ট মহাখালীর রাওয়া ক্লাবে অবসরপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তারা সংবাদ সম্মেলন করে শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি না চালানোর আহ্বান জানান। সাবেক সেনাপ্রধান এম নুরুদ্দিন খান সেখানে বলেন, সেনাবাহিনীর অবস্থানে তিনি আশ্বস্ত হয়েছেন এবং আর কোনো রক্তপাত হবে না বলে আশা প্রকাশ করেন।

এ বিষয়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) হাসিনুর রহমান বলেন, শেখ হাসিনা সেনাবাহিনীকে গুলি চালানোর নির্দেশ দিলেও সেনাপ্রধান তা অমান্য করায় আন্দোলন ছাত্র-জনতার পক্ষে চলে যায়। সেনাবাহিনীর অবস্থান পরিষ্কার হওয়ায় আন্দোলন আরও বেগবান হয়। অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য ও তাদের পরিবারও বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে ছাত্র-জনতার পক্ষে মিছিল করে।

১৯৮২ সালে রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারের সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেছিলেন সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। তার শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে চলা ছাত্র ও জনতার আন্দোলন নব্বইয়ে চূড়ান্ত রূপ নেয়। অক্টোবরে আন্দোলন আরও জোরালো হয় এবং নভেম্বরের শেষে দেশজুড়ে অচলাবস্থা তৈরি হয়। ২৪টি ছাত্রসংগঠন একযোগে আন্দোলন চালাতে থাকে। অনেক শিক্ষক, চিকিৎসক ও সরকারি কর্মকর্তা আন্দোলনের সমর্থনে পদত্যাগ করেন বা কর্মবিরতিতে যান।

৩ ডিসেম্বর এরশাদ শান্তি আলোচনায় রাজি হলেও ৪ ডিসেম্বর লাখো মানুষ ঢাকায় বিক্ষোভে নামে। সেনাবাহিনী সরকারের পক্ষে গুলি না চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়, যার ফলে ৬ ডিসেম্বর এরশাদ পদত্যাগে বাধ্য হন।

সে সময় সেনাপ্রধান ছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) এম নুরুদ্দিন খান। জাতীয় পার্টির সাবেক পানি উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী মেজর (অব.) মনজুর কাদের জানান, নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়েই সেনাবাহিনীর সমর্থন হারানোর বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যায়। এরশাদ শেষ মুহূর্তে সেনাপ্রধানকে ফোন করলেও উত্তর পাননি। বাধ্য হয়ে তিনি সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।

মনজুর কাদের আরও জানান, ক্ষমতা হস্তান্তরের পর বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এরশাদ ফের ক্ষমতায় ফেরার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেন, যার ফলে ছাত্ররা আবার উত্তাল হয়ে ওঠে এবং শেষ পর্যন্ত এরশাদ গ্রেফতার হন।

Link copied!