রবিবার, ২১ ডিসেম্বর, ২০২৫

কাবাব, বিরিয়ানিসহ ‍‍`বাহারি স্বাদের শহর‍‍` লখনৌকে ‘গ্যাস্ট্রোনমি’র স্বীকৃতি দিল ইউনেস্কো

টিএনসি ডেস্ক

প্রকাশিত: : ডিসেম্বর ২০, ২০২৫, ০৮:১১ পিএম

ইতিহাস, ধীরলয়ের রান্না আর নবাবি স্বাদের ঐতিহ্যে ভর করে ভারতের লখনৌ এবার ইউনেস্কোর ‘ক্রিয়েটিভ সিটি অব গ্যাস্ট্রোনমি’ স্বীকৃতি পেল, যা শহরের সমৃদ্ধ খাদ্যসংস্কৃতিকে এনে দিল বৈশ্বিক স্বীকৃতি।

কাবাব, বিরিয়ানিসহ ‍‍`বাহারি স্বাদের শহর‍‍` লখনৌকে ‘গ্যাস্ট্রোনমি’র স্বীকৃতি দিল ইউনেস্কো

জিভে জল আনা কাবাব, সুগন্ধি বিরিয়ানি কিংবা মুখে দিলেই মিলিয়ে যাওয়া সব মিষ্টি—ভোজনরসিকদের কাছে ভারতের লখনৌ মানেই এক টুকরো স্বর্গ। স্থানীয় বাসিন্দা হোন বা পর্যটক, লখনৌয়ের খাবারের জাদুতে মজে থাকেন সবাই।

সেই ঐতিহ্যের স্বীকৃতিও মিলল এবার। গত মাসে ইউনেস্কো লখনৌকে ‍‍`ক্রিয়েটিভ সিটি অব গ্যাস্ট্রোনমি‍‍` হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

২০০৪ সালে ইউনেস্কো সিদ্ধান্ত নেয়, বিশ্বের ঐতিহ্যবাহী শহরগুলোকে সাহিত্য, সংস্কৃতি, লোকশিল্প ও খাদ্য সংস্কৃতির নিরিখে বিবেচনা করে ‍‍`দ্য ক্রিয়েটিভ সিটিজ় নেটওয়ার্ক‍‍`–এর আওতায় আনা হবে। এর মধ্যে খাবারের ঐতিহ্য, তার ধারাবাহিকতা ও উদ্‌যাপনের উ‍পর ভিত্তি করে দেওয়া হয় এই ক্রিয়েটিভ সিটি অফ গ্যাস্ট্রোনমির তকমা। বিশ্বের ৪০৮টি শহর এই নেটওয়ার্কে।

খাবারের জন্য বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত ৭০টি শহরের তালিকায় ভারতের দ্বিতীয় শহর হিসেবে জায়গা করে নিল লখনৌ। এর আগে ২০১৯ সালে হায়দরাবাদ এই মর্যাদা পেয়েছিল। এছাড়াও, ইউনেস্কোর ‍‍`ক্রিয়েটিভ সিটি অফ গ্যাস্ট্রোনমি‍‍` তকমা পেয়েছে ম্যাকাও, পানামা সিটি, ফুকেট, সান আন্তোনিও–সহ ৬৯টি শহর।

ইউনেস্কোর দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক কার্যালয়ের পরিচালক টিম কার্টিস বলেন, ‍‍`এই স্বীকৃতি লখনৌয়ের গভীর খাদ্য ঐতিহ্য ও বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতিকেই তুলে ধরে। এটি শহরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সম্মান জানানোর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সহযোগিতার নতুন পথ খুলে দেবে।‍‍`

লখনৌয়ের এই অর্জনে অবশ্য অবাক নন শহরবাসী। তারকা শেফ রণবীর ব্রারের কথায় যেন সবার মনের কথাই ফুটে উঠল, ‍‍`দেরিতে হলেও স্বীকৃতিটা এল। এটা আরও আগেই হওয়া উচিত ছিল।‍‍`

ভারতের সবচেয়ে জনবহুল রাজ্য উত্তর প্রদেশের রাজধানী এই লখনৌ। কোলাহলপূর্ণ, বৈচিত্র্যময় এই শহরটির আত্মা আসলে লুকিয়ে আছে এর খাবারে। ইউনেস্কোর স্বীকৃতি যেন সেই সত্যটিকেই আবার সবার সামনে নিয়ে এল।

লখনৌয়ের খাবারের স্বাদে কেন এত ভিন্নতা? ‍‍`সনৎকদা ট্রাস্ট‍‍`-এর প্রতিষ্ঠাতা মাধবী কুক্রেজা বিবিসিকে বলেন, এখানকার খাবারের আসল রহস্য হলো ‍‍`ধীর লয়‍‍`। অর্থাৎ সময় নিয়ে যত্ন করে রান্না করা। তিনি বলেন, ‍‍`কী রান্না হবে, কীভাবে হবে—অধিকাংশ বাড়িতে ঘুম থেকে ওঠা থেকে ঘুমাতে যাওয়া পর্যন্ত এই আলোচনাই চলতে থাকে। আসলে লখনৌতে আপনার রান্নাঘরের খাবারের মান দিয়েই আপনাকে বিচার করা হবে।‍‍`

তবে খাবার নিয়ে লখনৌবাসীর এই আবেগ বা চর্চা নতুন কিছু নয়। শত শত বছর ধরেই এই শহরের পরিচয়ের সঙ্গে মিশে আছে এর অতুলনীয় সব পদ।

অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর ধনী মুসলিম শাসকদের হাত ধরেই লখনৌ পরিচিতি পায় ‍‍`নবাবদের শহর‍‍` হিসেবে। তাঁদের হেঁশেলেই জন্ম নিয়েছে মুখে দিলেই মিলিয়ে যাওয়া কাবাব আর বিরিয়ানির এক বিশেষ ঘরানা। পারস্য আর স্থানীয় ভারতীয় রান্নার কায়দা মিশিয়ে তৈরি হয়েছে ‍‍`আওয়ধি‍‍` খানা, যা স্বাদ ও গন্ধে আজও অতুলনীয়।

লখনৌয়ের বিখ্যাত সব কাবাবের জন্মও হয়েছে ওই নবাবি আমলেই। বিশেষ করে মাটন গালোটি কাবাবের পেছনের গল্পটা বেশ মজার। কথিত আছে, এক বৃদ্ধ নবাবের দাঁত পড়ে গিয়েছিল, কিন্তু মাংস খাওয়ার শখ তো আর যায়নি! তাঁর জন্যই রাঁধুনিরা পেঁপে, জাফরান আর নানা মসলা মিশিয়ে মাংসের কিমা এমন মিহি করে ফেললেন যে চিবোনোর দরকারই পড়ে না। সেই থেকেই গালোটি কাবাব লখনৌয়ের ‍‍`ট্রেডমার্ক‍‍` হয়ে গেল।

আওয়ধের রাঁধুনিদের সম্ভবত সবচেয়ে বড় অবদান ‍‍`দম পুক্ত‍‍` রান্নার কৌশল। মৃদু আঁচে হাঁড়ির মুখ আটা দিয়ে বন্ধ করে দীর্ঘ সময় ধরে ভাপে রান্না করা হয় এই পদ্ধতিতে।

অষ্টাদশ শতাব্দীতে নবাব আসাফ-উদ-দৌলার সময়ে এর প্রচলন বাড়ে। তখন রাজ্যে দুর্ভিক্ষ চলছিল, নবাব চালু করলেন ‍‍`কাজের বিনিময়ে খাদ্য‍‍` কর্মসূচি। শ্রমিকদের জন্য বিশাল ডেকচিতে চাল, ডাল, সবজি, মাংস আর মসলা সব একসঙ্গে দিয়ে মুখ বন্ধ করে রান্না করা হতো। কথিত আছে, হাঁড়ি থেকে বের হওয়া গন্ধে মোহিত হয়ে নবাব নিজেও সেই খাবার চেখে দেখেন। এরপরই রাজকীয় হেঁশেলে পাকাপাকিভাবে জায়গা করে নেয় ‍‍`দম‍‍` রান্নার কৌশল।

আধুনিক ভারতে এই রান্নার কৌশলটিকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন প্রয়াত শেফ ইমতিয়াজ কোরেইশি। আওয়ধি রান্নার এই জাদুকরই দিল্লির বিখ্যাত রেস্তোরাঁ ‍‍`বুখারা‍‍` ও ‍‍`দম পুক্ত‍‍`-এর নেপথ্য কারিগর ছিলেন। এশিয়ার সেরা ৫০ রেস্তোরাঁর তালিকায় এই নামগুলো এখন জ্বলজ্বল করছে।

শুধু কাবাব বা বিরিয়ানিই নয়; কোরমা, শিরমাল (একধরনের জাফরানি রুটি) কিংবা শাহী টুকরার (ব্রেড পুডিং) মতো পদের জন্যও লখনৌ বিখ্যাত।

লখনৌ মানেই যে শুধু মাংসের পদ, তা কিন্তু নয়। স্থানীয় বানিয়া সম্প্রদায়ের সুবাদে এখানে নিরামিষ খাবারেরও দারুণ কদর। মৌসুমি সবজির পাশাপাশি হরেক পদের মিষ্টি আর ‍‍`চাট‍‍`-এর মতো মুখরোচক স্ট্রিট ফুড লখনৌকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা। শহরের অলিগলিতে ছড়িয়ে থাকা ছোট ছোট দোকানগুলো স্থানীয় ভোজনরসিকদের কাছে একেকটি ‍‍`লুকানো রত্ন‍‍`।

শহরের কেন্দ্রে হজরতগঞ্জের কথাই ধরা যাক। সেখানকার ‍‍`শর্মা জি টি স্টল‍‍`-এ ভোর পাঁচটা না বাজতেই ভিড় জমতে শুরু করে। মাটির ভাঁড়ে গরম মসলা চা আর হাতে বানানো সাদা মাখন মাখানো নরম বনরুটির টানে মানুষ এখানে ছুটে আসে। প্রাতঃভ্রমণকারী থেকে শুরু করে রাজনীতিক কিংবা সাংবাদিক—সবার আড্ডা জমে ১৯৪৯ সাল থেকে চালু থাকা এই সাদামাটা দোকানটিতে। পর্যটকদের কাছেও এখন এটি দর্শনীয় স্থান।

পুরোনো লখনৌয়ের স্বাদ নিতে নাশতার জন্য যাওয়া যেতে পারে আমিনাবাদের ‍‍`নেত্রাম‍‍`-এ। ১৮৮০ সালে চালু হওয়া জৌলুশহীন এই দোকানটি প্রায় ১৫০ বছর ধরে গরম কচুরি আর জিলাপির জন্য বিখ্যাত। ডালের পুর দেওয়া কচুরি আর রসে টলটলে জিলাপির স্বাদ নিতে এখনো মানুষ এখানে লাইন দেয়।

বর্তমানে দোকানটি সামলাচ্ছেন ষষ্ঠ প্রজন্মের আনমোল আগরওয়াল এবং তাঁর দুই ছেলে অনুপ ও প্রাংশু। পারিবারিক এই ঐতিহ্য ও রান্নার গোপন প্রণালি তাঁরা সযত্নে আগলে রেখেছেন। অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়লেও প্রাংশু পারিবারিক এই পেশাকেই ভালোবেসেছেন। তাঁর কথায়, ‍‍`এই পেশা আমার রক্তে মিশে আছে। এর বাইরে আমি আর কিছুই করতে চাই না।‍‍`

লখনৌয়ের আরেকটি বিশেষত্ব হলো এর মৌসুমি খাবার। শীতের সকালে এখানে মিলবে এক আশ্চর্য মিষ্টান্ন—‍‍`মাখন বালাই‍‍`। মুখে দিলেই মেঘের মতো মিলিয়ে যাওয়া এই খাবার তৈরির প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল ও বিজ্ঞানসম্মত। দুধ দীর্ঘ সময় ধরে হাতে ফেটিয়ে সারা রাত খোলা আকাশের নিচে রেখে দেওয়া হয়। ভোরের শিশিরেই তৈরি হয় এর জাদুকরী ফেনা ও স্বাদ।

শীতের ভোরে আমিনাবাদ বা চকের মতো পুরোনো এলাকায় এর পসরা সাজিয়ে বসেন বিক্রেতারা। তবে এত স্বাদের ভিড়েও আছে শঙ্কার সুর। অনেক কারিগরই জানালেন, এই কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ কাজ শিখতে চাইছে না তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম। ফলে হারিয়ে যেতে পারে এই ঐতিহ্য।

লখনৌয়ের সন্তান তারকা শেফ রণবীর ব্রার সব সময়ই নিজ শহরের খাবারের বড় প্রচারক। তার মতে, ভারতের স্ট্রিট ফুডের অভিজ্ঞতায় লখনৌ সবার ওপরে। তবে ইউনেস্কোর এই স্বীকৃতির সার্থকতা তখনই আসবে, যখন লখনৌয়ের অলিগলিতে লুকিয়ে থাকা ছোট ও কম পরিচিত দোকানগুলোও মানুষের নজরে আসবে।

মাধবী কুক্রেজার মতে, লখনৌয়ের প্রতিটি খাবারের পেছনেই একটি গল্প আছে। ফুটপাতের ছোট দোকান থেকে শুরু করে বড় রেস্তোরাঁ—বংশপরম্পরায় গোপন রেসিপিগুলো আগলে রেখেছেন কারিগররা। তার আশা, আন্তর্জাতিক এই স্বীকৃতি বিশ্বের ভোজনরসিকদের লখনৌমুখী করবে। তারা আসবেন, এখানকার খাবারের স্বাদ নেবেন এবং জানবেন এই শহরের না-বলা গল্পগুলো।

Link copied!