প্রকাশিত: : অক্টোবর ১৮, ২০২৫, ১২:১৩ এএম
ছবিঃ Unsplash
একটি মেটা-বিশ্লেষণে ২১৮টি ট্রায়াল ও ১৪,০০০-এর বেশি অংশগ্রহণকারীর তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, হতাশা উপশমে নাচ অন্যান্য প্রচলিত শারীরিক ব্যায়ামের তুলনায় বেশি কার্যকর। ছবি: নিক ফ্যানচার
প্রতি মিনিটে ১২৮ বিটে বাজছে বেস মিউজিক। ভিড়ঠাসা ডান্স ফ্লোরে শরীরগুলো এক ছন্দে দুলছে। বাইরের একজন দর্শকের কাছে এটি কেবল এক ধরনের ভোগবিলাসী পার্টি মনে হতে পারে। কিন্তু একজন স্নায়ুবিজ্ঞানীর চোখে এটি অনেকটা দলবদ্ধ থেরাপির মতো।
ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর এম্পিরিক্যাল অ্যাসথেটিকস-এর স্নায়ুবিজ্ঞানী ও ড্যান্সিং ইজ দ্য বেস্ট মেডিসিন- বইয়ের লেখক জুলিয়া এফ. ক্রিস্টেনসেন বলেন, `নাচ শরীরের ভাষা।`
তিনি বলেন, `নাচের সময় আমরা যেসব অঙ্গভঙ্গি করি, আমাদের মস্তিষ্ক সেগুলোকে এক ধরনের প্রকাশভঙ্গির ভাষা হিসেবে মনে করে।`
শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বিভিন্ন সমাজ নাচকে শুধু উৎসবের জন্য নয়, বরং আচার ও নিরাময়ের মাধ্যম হিসেবেও ব্যবহার করেছে। বিজ্ঞানীরা মস্তিষ্কের তরঙ্গ পর্যবেক্ষণ বা নিউরোট্রান্সমিটার পরিমাপ শুরু করার বহু আগে থেকেই নৃত্যশিল্পীরা একসঙ্গে অঙ্গ সঞ্চালনের শক্তিকে সহজাতভাবেই বুঝতেন।
এখন গবেষণাও এই বিষয়টিকে সমর্থন করতে শুরু করেছে।
২০২৪ সালে বিএমজে -তে প্রকাশিত একটি মেটা-বিশ্লেষণে ২১৮টি ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, নাচ বিষন্নতা কমাতে হাঁটা, যোগব্যায়াম, ওজন প্রশিক্ষণ এবং এমনকি প্রচলিত ওষুধের চেয়েও বেশি কার্যকর।
যদিও মাত্র ১৫টি স্টাডি সরাসরি নাচ নিয়ে ছিল, তবুও ফলাফল গবেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটির অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর ও এই রিভিউয়ের প্রধান লেখক মাইকেল নোটেল বলেন, `নাচ নিয়ে অন্তত পাঁচটি স্টাডি আছে জেনে আমি অবাক হয়েছিলাম।`
তিনি আরও বলেন, `"শারীরিক কসরত, সামাজিক যোগাযোগ এবং সুরের সমন্বয়—এসব মিলেই নাচ এত কার্যকর।`
তবে গবেষকরা সতর্ক করে বলছেন, নাচকে স্বতন্ত্র চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে বিবেচনার আগে আরও বৃহৎ পরিসরে গবেষণা প্রয়োজন।
২০২৩ সালের গ্যালাপ জরিপ অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে ২৯ শতাংশের বেশি প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের কোনো এক সময়ে বিষন্নতা আক্রান্ত হন এবং অনেকের জন্য এই ধরনের রোগের চিকিৎসা বেশ ব্যয়বহুল হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে নাচ হতে পারে এক বিরল সুযোগ—এটি একদিকে আনন্দদায়ক ও সাশ্রয়ী, অন্যদিকে মানুষের সামাজিক মেলবন্ধনের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
কেন আপনার মস্তিষ্ক সুরের তালে নাচতে ভালোবাসে
আমাদের মস্তিষ্ক স্বভাবতই ছন্দের প্রতি সংবেদনশীল—আর নাচ পুরো স্নায়ুতন্ত্রকে সক্রিয় করে তোলে। কিছু স্নায়ুবিজ্ঞানী এই পূর্ণ-শারিরীক উদ্দীপনাকে এক ধরনের `নিউরোকেমিক্যাল সিম্ফনি` বলে অভিহিত করেছেন।
সুরের পরবর্তী অংশের পূর্বাভাসই ডোপামিন নিঃসরণ ঘটাতে পারে। শারীরিক নড়াচড়া এন্ডোরফিন বাড়ায়। অন্যদের সঙ্গে নাচলে অক্সিটোসিন বেড়ে যায়।
গবেষণায় দেখা গেছে, এই তিনটি উপাদানের সম্মিলিত প্রভাব মনোভাব উন্নত করে, সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করে এবং মানসিক চাপ কমায়।
ক্রিস্টেনসেন বলেন, এই উপাদানগুলোর সমন্বয়ই সম্ভবত নাচকে খেলাধুলা বা যোগব্যায়ামের মতো অন্যান্য অনুশীলন থেকে আলাদা করে।
তিনি বলেন, উদাহরণস্বরূপ `ডান্স মুভমেন্ট থেরাপি`-তে উদ্বেগ ও হতাশার লক্ষণ কমে যায় মূলত নাচের প্রকাশভঙ্গিমার কারণে।`
তিনি আরও বলেন, `যেসব অনুভূতি আপনার জন্য বোঝা হয়ে উঠেছে, নিজের অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে সেগুলো প্রকাশ করে এগুলোকে শরীর থেকে বের করে আনছেন।`
এই বিষয়টি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালেও পরিমাপযোগ্যভাবে ধরা পড়েছে।
নোটেল বলেন, `মানুষ যত বেশি উদ্দীপনার সঙ্গে নৃত্য করে, বিশেষ করে সংগীতের সঙ্গে, তত বেশি উপকার পাওয়া যায়।`
নাচের চূড়ান্ত মুহূর্তে যখন বিট পড়ে, মেঝে কাঁপে, আর সবাই একসঙ্গে নাচে, গবেষকরা `ইন্টারব্রেইন সিনক্রনি` নামের একটি ঘটনা লক্ষ্য করেছেন। এটি হলো মানুষের মধ্যে মস্তিষ্কের কার্যকলাপের সামঞ্জস্য, যা প্রায়ই ইইজি স্টাডিতে দেখা যায়।
ক্রিস্টেনসেন বলেন, অন্যদের সঙ্গে সমন্বয় করে অঙ্গ সঞ্চালন করায় আত্মপরিচয় ও একে অন্যের মধ্যকার সীমানা মুছে যায়। আর এর ফলে বিশ্বাস ও সংযোগ বেড়ে যায়।
নাচ কীভাবে আপনার মন ও শরীরকে নতুন করে গড়ে তোলে
হতাশায় ভোগা মানুষের জন্য কখনো কখনো সামান্য নড়াচড়াও কঠিন হয়ে পড়ে।
স্নায়ুবিজ্ঞানীরা দেখেছেন, এমন অবস্থায় মুখাবয়বের অভিব্যক্তি, অঙ্গভঙ্গি ও ভঙ্গিমা কমে যায়, যা অনেকটা শরীরের `আবেগীয় শব্দভান্ডার` হারানোর মতো।
নাচ এই সংযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠার এক অনন্য উপায়। এটি আবেগ, চিন্তা ও ইন্দ্রিয়গত পথগুলো সক্রিয় করে তোলে, আত্মসচেতনতা ও পারিপার্শ্বিক সংযোগ জাগিয়ে তোলে।
হতাশা কেবল মন-মেজাজেই প্রভাব ফেলে না, এটি নিজের শরীর ও অন্যদের সঙ্গে সম্পর্কেও প্রভাব ফেলে।
ক্রিস্টেনসেন বলেন, `মানুষের মস্তিষ্কের সুস্থ থাকতে আশেপাশে অন্য মানুষ থাকা প্রয়োজন—শারীরিক ও মানসিক উভয়ভাবেই।`
তিনি বলেন, `বিবর্তনগত কারণে, আমাদের মস্তিষ্ক যদি একা হয়ে যায়, তবে তা সারভাইভাল মোডে চলে যায়।`
নাচ এমন একটি অনন্য সুযোগ দেয় যা কথার থেরাপি দিতে পারে না— তা হলো ভাষা ছাড়াই আবেগ প্রকাশের সুযোগ।
তিনি আরও বলেন, `নাচ মানুষকে এমন কিছু আবেগ প্রকাশ করতে সাহায্য করে, যেটা হয়তো ভাষায় বলা সম্ভব নয়। অনেকের জন্য এটি দারুণ নিরাময়কর এবং কথার থেরাপির ক্ষেত্রেও সহায়ক হতে পারে।`
সম্ভবত এ কারণেই সবচেয়ে কার্যকর ক্লিনিক্যাল গবেষণাগুলোতে দেখা গেছে, শুধু অঙ্গ সঞ্চালন নয়, বরং সুরের সঙ্গে অন্যদের সঙ্গে নাচার মধ্য দিয়েই সবচেয়ে ভালো ফল মিলেছে। এটি নাচের কার্যকারিতার মূল চাবিকাঠি বলে মনে করেন নোটেল।
শুধু মন ভালো করা বা শরীরচর্চা ছাড়াও, দলবদ্ধভাবে নাচ মানুষের একটি অনন্য উপকার করে—তা হলো গভীর সামাজিক সংযোগ।
১৯৮০-এর দশকের জুয়ান অ্যাটকিনসের মতো ডেট্রয়েটে কৃষ্ণাঙ্গ উদ্ভাবকেরা ড্রাম মেশিন ব্যবহার করে তরুণদের পার্টিতে যে সুর সৃষ্টি করেছিলেন, তা-ই পরে হাউস ও টেকনো সংগীত হয়ে ওঠে। এটি কেবল সংগীতের নতুনত্ব ছিল না; বরং এটি ছিল একধরনের সামাজিক নিরাময় কেন্দ্র, যেখানে কঠিন সময়ে মানুষ একত্র হতো।
সাংস্কৃতিক ইতিহাসবিদ ও নৃতত্ত্ব সংগীতবিদেরা এই স্থানগুলোকে আনন্দ, প্রতিরোধ ও সংহতির গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
জুলিয়া এফ. ক্রিস্টেনসেন বলেন, একসঙ্গে নাচলে মানুষের মধ্যে সীমারেখাগুলো ফিকে হয়ে যায়।
তিনি বলেন, `আমরা যদি ছন্দে ছন্দে একসঙ্গে নড়াচড়া করি, তবে তা আমাদের মস্তিষ্ককে এক ধরনের ইতিবাচক বিভ্রান্তিতে ফেলে এবং `আমি` ও `তুমি`র পার্থক্য মুছে যায়।
স্নায়ুবিজ্ঞানীরা একে `কো-রিপ্রেজেন্টেশন` বলেন। এটি পারস্পরিক বন্ধন, বিশ্বাস ও সহানুভূতি বাড়াতে সাহায্য করে—যা মানসিক সুস্থতার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
এই বিষয়গুলো মাথায় রেখে এখন থেরাপি ও সামাজিক যত্নে নৃত্যভিত্তিক কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। যারা ভাষায় নিজেকে প্রকাশ করতে পারেন না বা সামাজিক বিচ্ছিন্নতায় ভোগেন, তাদের জন্য নৃত্যভিত্তিক কার্যক্রম ব্যবহার করা হচ্ছে।
যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (এনএইচএস) ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত বয়স্কদের জন্য ডান্স প্রোগ্রাম পরিচালনা করে।
অস্ট্রেলিয়ায় গবেষণায় দেখা গেছে, সব বয়সী মানুষের জন্য কাঠামোবদ্ধ নৃত্য মানসিক স্বাস্থ্য, উদ্দীপনা ও মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে অন্যান্য ব্যায়ামের চেয়ে বেশি কার্যকর হতে পারে।
ডান্স ফ্লোরে নিজের পথ খুঁজে পাওয়া
গবেষকরা বলছেন, গবেষণাগারে হতাশা নিরাময়ের পদ্ধতিগুলো সাধারণত উপসর্গ কমানোর ওপর কেন্দ্রীভূত থাকে। কিন্তু নাচ শুধু উপসর্গ নয়, বরং আনন্দের মুহূর্ত সৃষ্টি করে।
সালসা ক্লাস থেকে শুরু করে ক্লাবের ডান্স ফ্লোর—সর্বত্র দেখা গেছে, সংগীত ও সামাজিক সম্পৃক্ততা-ভিত্তিক প্রোগ্রামগুলোই সবচেয়ে কার্যকর। এসব পরিবেশে সৃজনশীলতা ও ব্যক্তিগত প্রকাশের সুযোগ থাকে, যা হতাশায় ক্ষতিগ্রস্ত আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে সহায়ক।
এখন স্কুল, কলেজ ও প্রবীণদের সেবাকেন্দ্রগুলোতে নৃত্যশিক্ষকরা কৌশলগত নিখুঁততা নয়, বরং অভিব্যক্তিমূলক নাচ এবং সামাজিক সংযোগকে গুরুত্ব দিচ্ছেন।
নাচ হতাশায় ক্ষয়প্রাপ্ত `নিজস্বতাবোধ` ফিরিয়ে আনতে পারে। এতে মানুষ নিজের ছন্দ, ভঙ্গি ও পথ নিজেই বেছে নিতে পারে।
ক্রিস্টেনসেন বলেন, `যারা এখনও জানেন না নাচ কী করতে পারে, তারা হয়তো এখনও নিজেদের নাচের ধরন খুঁজে পাননি। বিশ্বজুড়ে শত শত নাচের ধরন রয়েছে—সবার জন্য কিছু না কিছু আছে।`
বিশেষজ্ঞদের মতে, দিন দিন মানসিক স্বাস্থ্যসেবা যেখানে বিকশিত হচ্ছে, সেখানে নাচ শুধুই বিনোদন নয়, বরং একটি কার্যকর থেরাপি হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে।