প্রকাশিত: : ডিসেম্বর ২২, ২০২৫, ১২:১৪ পিএম
দেশের অধিকাংশ স্কুলে মানসম্মত স্যানিটেশন, আলাদা টয়লেট ও মাসিককালীন স্বাস্থ্যসেবার ঘাটতি শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যঝুঁকি, অনুপস্থিতি এবং শিক্ষায় লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য বাড়াচ্ছে—বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর নতুন জরিপে এমন উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে।
স্বাস্থ্যকর পরিবেশ ও শিক্ষার্থীদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে মানসম্মত স্যানিটেশন ব্যবস্থা থাকা জরুরি। কিন্তু দেশের প্রায় ৭১ দশমিক ৪ শতাংশ বিদ্যালয়ে নেই মানসম্মত স্যানিটেশনের সুবিধা। ৫০ জন শিক্ষার্থীর জন্য একটি উন্নত টয়লেট (আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ন্যূনতম সুবিধা) আছে ২৮ দশমিক ৬ শতাংশ স্কুলে। এছাড়া ছেলে ও মেয়ে উভয় শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা স্যানিটেশন সুবিধা থাকা বাঞ্ছনীয় হলেও ৮০ শতাংশ স্কুলে কিশোরীদের জন্য পৃথক, নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেট নেই। মৌলিক মাসিককালীন সেবা পায় মাত্র ৬ দশমিক ৯ শতাংশ স্কুলের মেয়েরা।
দেশের স্কুলগুলোতে মানসম্মত স্যানিটেশন ও স্বাস্থ্যবিধি ব্যবস্থাপনায় ঘাটতির এ চিত্র উঠে এসেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) নতুন এক জরিপে। গতকাল ‘ওয়াশ ইন এডুকেশন অ্যান্ড হেলথ কেয়ার ফ্যাসিলিটিজ সার্ভে-২০২৪’ শীর্ষক ওই জরিপের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
এতে বলা হয়েছে, এসব সুবিধার ঘাটতি শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে অনুপস্থিতি, অস্বস্তি এবং শিক্ষায় লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যকে বাড়িয়ে তুলছে।
বিবিএস বলছে, উন্নত পানির উৎসের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আর্থিক বরাদ্দের পরিমাণ অত্যন্ত সীমিত, যা বিদ্যমান ব্যবস্থার টেকসই হওয়াকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে। জরিপে আটটি বিভাগ এবং ৬৪টি জেলার স্কুল থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। যার মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
বিবিএসের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ৫০ জন শিক্ষার্থীর জন্য ন্যূনতম একটি উন্নত টয়লেট আছে দেশের ২৮ দশমিক ৬ শতাংশ স্কুলে। শহরে এ হার ২৮ দশমিক ৭ ও গ্রামে ২৮ দশমিক ৩ শতাংশ। স্কুলভেদে ন্যূনতম উন্নত টয়লেট সুবিধা প্রাপ্যতায় পিছিয়ে বেসরকারি স্কুল। মাত্র ২২ দশমিক ৮ শতাংশ বেসরকারি স্কুলে এ সুবিধা রয়েছে। সরকারি স্কুলে এ হার ৩৫ দশমিক ২, এমপিওভুক্ত স্কুলে ১৮ দশমিক ৪ এবং এনজিও ও অন্যান্য সংস্থা পরিচালিত স্কুলে এ হার ৪২ দশমিক ১ শতাংশ যা সবচেয়ে বেশি।
দেশের অঞ্চলভেদে উন্নত টয়লেট সুবিধায় বৈষম্য রয়েছে। খুলনা বিভাগে সর্বোচ্চ ৪৫ দশমিক ১ শতাংশ স্কুলে ৫০ জন শিক্ষার্থীর জন্য ন্যূনতম একটি উন্নত টয়লেট রয়েছে। সবচেয়ে নাজুক অবস্থা রাজশাহী বিভাগের। বিভাগটিতে মাত্র ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ স্কুলে ৫০ জনের বিপরীতে একটি উন্নত টয়লেট আছে। চট্টগ্রামে এ হার ৩৪ দশমিক ২, সিলেটে ৩১ দশমিক ৪, রংপুরে ৩০ দশমিক ৬, বরিশালে ৩০ দশমিক ৪, ঢাকায় ২২ দশমিক ৭ ও ময়মনসিংহে ১৯ দশমিক ৩ শতাংশ।
জরিপের ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দেশের শতকরা ৯৫ দশমিক ৪ শতাংশ স্কুলে ও ৮৭ দশমিক ৫ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে উন্নত পানির উৎসে প্রবেশগম্যতার সুবিধা রয়েছে, যা তুলনামূলকভাবে উচ্চহারে রয়েছে। তবে মৌলিক পানিসেবার সংজ্ঞা অনুযায়ী, উন্নত পানির উৎস প্রতিষ্ঠান প্রাঙ্গণের ভেতরে থাকতে হয়—এ মানদণ্ড পূরণ করে এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম, যা পরিবেশ দূষণ ও রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়। ৮৬ শতাংশ স্কুল এবং ৭০ দশমিক ৫ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান এ মানদণ্ড পূরণ করে। তবে দেশের মাত্র ৫৫ দশমিক ৪ শতাংশ স্কুলে প্রতিবন্ধীদের জন্য উপযোগী উন্নত পানির পয়েন্টে প্রবেশগম্যতার সুবিধা রয়েছে। অপরদিকে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোয় এ হার আরো কম, মাত্র ৪০ দশমিক ৯ শতাংশ।
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে সারা বিশ্বে সবার জন্য পরিচ্ছন্ন শৌচাগার থাকার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ এসডিজি অর্জনে এখনো পিছিয়ে রয়েছে। এ লক্ষ্যমাত্রা পূরণে পাঁচ বছরের মধ্যে সব ক্ষেত্রে উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হলে নানামুখী উদ্যোগ নিতে হবে।
এর আগে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) এক গবেষণায় স্কুলে স্যানিটেশন ব্যবস্থার শোচনীয় চিত্র ফুটে উঠেছে। ওই গবেষণা অনুযায়ী, দেশের ৮৪ শতাংশ স্কুলে উন্নত এবং ১২ শতাংশ স্কুলে অনুন্নত ল্যাট্রিন আছে। স্কুলগুলোর ৫৫ শতাংশ ল্যাট্রিনে তালা দেয়া থাকে। খোলা ল্যাট্রিনগুলোর মধ্যে মাত্র ২৪ শতাংশ ব্যবহার উপযোগী। ৮০ শতাংশ স্কুলে নিরাপদ পানির ব্যবস্থা আছে। কিন্তু ল্যাট্রিনের কাছাকাছি হাত ধোয়ার জন্য পানির ব্যবস্থা আছে মাত্র ৪৫ শতাংশ স্কুলে। পানি, সাবানসহ হাত ধোয়ার ব্যবস্থা আছে এক-তৃতীয়াংশ স্কুলে।
বিবিএস তাদের জরিপে আরো বলছে, মাত্র ১১ শতাংশ স্কুল এবং ৩৪ দশমিক ৯ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে ওয়াশ খাতে বরাদ্দ রয়েছে। ৯০ দশমিক ৬ শতাংশ স্কুল এবং ৯৮ দশমিক ৫ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে অন্তত একটি টয়লেট রয়েছে। তবে এর মান ও ব্যবহারযোগ্যতা নাজুক। অপরদিকে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে হাত ধোয়ার সুবিধা থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে পানি ও সাবান নেই। মাত্র ৫১ দশমিক ৭ শতাংশ স্কুল এবং ৫ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান হাত ধোয়ার মৌলিক সেবার মানদণ্ড পূরণ করতে পারছে। ফলে কার্যকর স্বাস্থ্যবিধি অনুশীলন ব্যাহত হচ্ছে এবং সংক্রমণ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের মান ক্ষুণ্ন হচ্ছে। নারীদের মাসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা সুবিধাও অপর্যাপ্ত।
এ বিষয়ে বিবিএসের এসডিজি সেলের ফোকাল পয়েন্ট আলমগীর হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফের জয়েন্ট মনিটরিং প্রোগ্রাম অনুযায়ী স্কুলে স্যানিটেশন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পানি ব্যবস্থাপনা যে মানদণ্ডে থাকার কথা সেখানে বাংলাদেশ একেবারে তলানিতে। শিক্ষার্থীদের টয়লেট সুবিধা আরো ভালো হতে পারত। সরকার এ খাতে বাজেট দেয়, কিন্তু সেটা কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে সেটার জন্য সরকারি কোনো তথ্য এতদিন ছিল না। এখন বিবিএস সেটি প্রকাশ করেছে। সামনের দিনে সরকারের নীতি প্রণয়ন, বাজেট করার ক্ষেত্রে এটি একটি গাইডলাইন হতে পারে।’
জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে মানসম্মত স্যানিটেশনের পাশাপাশি বড় চ্যালেঞ্জ মানববর্জ্য ব্যবস্থাপনায়। দেশে ৩৩ দশমিক ৯ শতাংশ স্কুল এবং ৪৫ দশমিক ৪ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে নিরাপদ মানববর্জ্য ব্যবস্থাপনা রয়েছে। জরিপে যেখানে ৭৮ দশমিক ৩ শতাংশ স্কুল উপযুক্ত কঠিন বর্জ্য নিষ্পত্তির কথা জানিয়েছে, সেখানে মাত্র ২৫ দশমিক ৪ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান চিকিৎসা-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মৌলিক মানদণ্ড পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে। এ মানদণ্ড অনুযায়ী বিপজ্জনক বর্জ্যের নিরাপদ পৃথক্করণ, প্রক্রিয়াকরণ ও নিষ্পত্তি নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
জরিপে আরো বলা হয়, গত ১২ মাসে ২৪ শতাংশ স্কুল এবং ১৯ দশমিক ৪ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হয়েছে। যার ফলে বহু ক্ষেত্রে পানি ও স্যানিটেশন অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ঝুঁকির পরও জলবায়ু সহনশীল ওয়াশ ব্যবস্থার জ্ঞান ও বাস্তবায়নের হার খুবই কম। মাত্র ৩৩ দশমিক ৭ শতাংশ স্কুল এবং ৯ দশমিক ৯ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থার রয়েছে। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়মিতভাবে মৌলিক সেবা ব্যাহত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে এবং ভবিষ্যতের জলবায়ুজনিত অভিঘাত মোকাবেলার সক্ষমতা হুমকির মুখে পড়ে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মৌলিক সুবিধা নেই এ কথা বহুদিন ধরে বলে আসছি। স্কুলগুলোতে স্যানিটেশন ব্যবস্থার নাজুক অবস্থা নিয়ে অনেক আগে থেকে গবেষণা হয়েছে। কিন্তু নীতিনির্ধারকরা সেটিকে গুরুত্ব দেননি। যখন স্কুলে স্যানিটেশন, পানির সুবিধা থাকবে না তখন শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমে যাবে। বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী শ্রীলংকা, ভুটানেও স্যানিটেশন ব্যবস্থা অনেক উন্নত, সে জায়গায় আমরা অনেক পিছিয়ে। এর অন্যতম কারণ তথ্য-উপাত্তের ঘাটতি, বিনিয়োগের অভাব ও সঠিক পরিকল্পনা না থাকা। স্যানিটেশন শুধু সুবিধা নয়, এর অভাব স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে, যা পরবর্তী সময়ে মেয়ে শিক্ষার্থীর মাতৃত্বকালীন স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। কাজেই এখানে প্রয়োজন তথ্য-উপাত্তভিত্তিক পরিকল্পনা ও শিক্ষা-স্বাস্থ্য বিনিয়োগ বাড়ানো।’