প্রকাশিত: : নভেম্বর ১৪, ২০২৫, ০৫:০৭ পিএম
বাংলাদেশে দ্রুত নগরায়ণ, বদলে যাওয়া খাদ্যাভ্যাস ও কমে যাওয়া শারীরিক পরিশ্রমের কারণে ডায়াবেটিসের হার উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় আক্রান্তের হারে দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা দেশে প্রতি সাতজন প্রাপ্তবয়স্কের একজনই এ রোগে ভুগছেন, যা নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত স্ক্রিনিং ও জীবনযাপনে পরিবর্তনের ওপর জোর দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের হারের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। দেশে প্রাপ্তবয়স্কদের (২০-৭৯ বছর) মধ্যে ১৩ দশমিক ২ শতাংশই কোনো না কোনোভাবে এ সমস্যায় ভুগছেন। ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশনের (আইডিএফ) সর্বশেষ প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়। দ্রুত নগরায়ণ, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, শারীরিক পরিশ্রম হ্রাস ও মানসিক চাপকে এর প্রধান কারণ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।
আইডিএফের প্রতিবেদন-২০২৪-এ দেয়া তথ্য অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে কেবল পাকিস্তানেই ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র রোগে আক্রান্তের হার বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। দেশটিতে ডায়াবেটিস সমস্যায় ভুগছে ৩১ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ। তবে জনসংখ্যার অনুপাতে আক্রান্তের হার বাংলাদেশেও উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। বর্তমানে দেশে প্রতি একজনের মধ্যে ১৩ দশমিক ২ শতাংশই এ সমস্যায় ভুগছেন। এর পরই যথাক্রমে আফগানিস্তান (১১ দশমিক ৭ শতাংশ), ভারত (১০ দশমিক ৫ শতাংশ), শ্রীলংকা (১০ দশমিক ২ শতাংশ), মালদ্বীপ (৯ দশমিক ৫ শতাংশ) ও নেপালের (৭ দশমিক ৭ শতাংশ) অবস্থান।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অতিরিক্ত ফাস্টফুড ও চর্বিযুক্ত খাবার খেলে, শারীরিক পরিশ্রম ও নিয়মিত শরীরচর্চা না করলে, মাত্রাতিরিক্ত ওজন বেড়ে গেলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক, কিডনি ফেইলিউর, অন্ধত্ব ও অঙ্গচ্ছেদের মতো মারাত্মক ও প্রাণঘাতী অসুখের ঝুঁকি থেকে দূরে থাকা সম্ভব। তার জন্য নিয়মিত ব্যায়াম করা, সুষম খাদ্য খাওয়া, চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত ওষুধ ও ইনসুলিন গ্রহণ, সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করতে হবে। সেই সঙ্গে ডায়াবেটিস নিয়ে সচেতনতার জন্য সবারই নিয়মিত রক্তের গ্লুকোজ পরীক্ষা করানো জরুরি। বিশেষ করে গর্ভবতী নারীরা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত কিনা, তাদের যত্ন এবং চিকিৎসায় বিশেষ নজর দিতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ডায়াবেটিসে আক্রান্তের হার বাড়ার প্রধান কারণ আমাদের জীবনধারা ও খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন। ভাত ও আলুর ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা, চিনি ও কোল্ড ড্রিংকসের বর্ধিত ব্যবহার এবং খাদ্যে ভেজালের উপস্থিতি রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা দ্রুত বাড়িয়ে দিচ্ছে। পাশাপাশি ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটির ঘাটতি, বিশেষ করে নারীদের মধ্যে পরিস্থিতি আরো জটিল করেছে। একসময় গ্রামীণ নারীরা কৃষিকাজ ও গৃহস্থালির শারীরিক পরিশ্রমে সক্রিয় থাকলেও এখন অটোমেশনের কারণে সে কর্মকাণ্ড কমে গেছে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে সচেতনতা ও নিয়মিত স্ক্রিনিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে শনাক্তকরণ ও ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম চালুর দাবি জানান অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ। তিনি আরো বলেন, ‘জীবনযাপনে পরিবর্তন আনাও জরুরি—দৈনিক হাঁটাহাঁটির পাশাপাশি প্রয়োজন শর্করা কম গ্রহণ ও সফট ড্রিংকস পরিহার। সরকার চাইলে দক্ষিণ কোরিয়ার মতো স্বাস্থ্য বীমা বা ইনসেনটিভ-ভিত্তিক নীতি গ্রহণ করতে পারে, যেখানে নিয়মিত ব্যায়াম ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা করলে নাগরিকরা বিশেষ সুবিধা পাবে।’
আইডিএফের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের মোট প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যা ১১ কোটি ৩০ লাখ ৫৪ হাজার ৫০০। এর মধ্যে ১৩ দশমিক ২ শতাংশ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। সে হিসাবে ১ কোটি ৩৮ লাখ ৭৭ হাজার ৪০০ জনই কোনো না কোনোভাবে এ সমস্যায় ভুগছেন। তবে বিশেষজ্ঞরা জানান, আক্রান্তের সংখ্যা আরো বেশি। কারণ ডায়াবেটিসের রোগীদের একটি বড় অংশই নিজেদের রোগ সম্পর্কে অবগত নয়।
ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে অষ্টম। বর্তমান ধারায় চলতে থাকলে ২০৪৫ সালে দেশে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা হবে ২ কোটি ২৩ লাখ। তবে দেশের ৪৩ দশমিক ৫ শতাংশ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের রোগ নির্ণয় হচ্ছে না বলে জানায় আইডিএফ।
ব্যাপক হারে রোগটি বেড়ে যাওয়ায় আইডিএফ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৯১ সালে ১৪ নভেম্বরকে ডায়াবেটিস দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। সেই থেকে বিশ্বজুড়ে বহুমূত্র সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে এ দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এ বছরের প্রতিপাদ্য—‘কর্মস্থলে ডায়াবেটিস সচেতনতা গড়ে তুলুন’।
বর্তমানে তরুণদের একটি বড় অংশ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে বলে জানান বারডেম জেনারেল হাসপাতালের এন্ডোক্রাইনোলজি ও ডায়াবেটোলজি বিভাগের (ইউনিট-১) বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মো. ফিরোজ আমিন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘তরুণদের পাশাপাশি ছয়-সাত বছরের শিশুরাও টাইপ টু ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। এটি আগে হতো না। টাইপ টু ডায়াবেটিস জীবনযাপন পদ্ধতির ওপর নির্ভর করে। আবার প্রাপ্তবয়স্করা যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত তাদেরও কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়। সেক্ষেত্রে ওয়ার্কিং প্লেস অনেক বড় একটি ফ্যাক্টর।’
অধ্যাপক ডা. মো. ফিরোজ আমিন বলেন, ‘এ বছরের ডায়াবেটিস দিবসের মূল প্রতিপাদ্য—কর্মস্থলে ডায়াবেটিস সচেতনতা গড়ে তুলুন। এর মানে হচ্ছে যে কর্মক্ষেত্রের পরিবেশটা এমন থাকা উচিত যাতে আমার ডায়াবেটিস না হয়। অর্থাৎ অনেকগুলো ফ্যাক্টর যেমন ডায়াবেটিস হওয়ার পেছনে স্ট্রেস একটা ফ্যাক্টর। আবার দেখা যাচ্ছে যে আমার ক্যান্টিনে যে খাবারগুলো থাকে সেগুলো হাই ক্যালরি ফুড। আবার অফিসটা এমন যে সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমার কোনো এক্সারসাইজ হচ্ছে না। সবকিছু মিলে দেখা যাচ্ছে যে লাইফস্টাইলে আমার ডায়াবেটিসের প্রবণতাটা বেড়ে যাচ্ছে। তাহলে কর্মক্ষেত্রে এমন একটা পরিবেশ থাকা উচিত যেখানে এসব বিষয় মাথায় রাখা হয়।’